নিজস্ব প্রতিবেদক,
চট্টগ্রামে লকডাউনের তেজ তেমন কোথাও নেই। যা পড়েছে সড়কে, আর নিত্যপণ্যের বাজারে। চট্টগ্রামে কোথাও এখন ৫০ টাকার নিচে কোনোরকম সবজি মিলছে না। কোনো কোনো সবজির কেজি ১০০ টাকাও ছাড়িয়ে গেছে। প্রভাব পড়েছে শুকনো ভোগ্যপণ্যের দোকানেও।
বেড়েছে মাছ-মাংস ও চালের দামও। এতে নাভিশ^াস উঠেছে সাধারণ ক্রেতাদের। ক্রেতাদের ভাষ্য, লকডাউনে একদিকে আয় রোজগার বন্ধ। অন্যদিকে ভোগ্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বি। এভাবে আর কয়েকটা দিন গেলে খেয়ে না খেয়ে জীবন বাচাতে হবে।
বিক্রেতাদের ভাষ্য, লকডাউনে চট্টগ্রামে সবকিছু খোলা। জংশন কমাতে যেখানে লকডাউন, সেখানে লকডাউন দেখতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে কৌতুহলি মানুষের ভিড় জমছে। তাতে লকডাউনের মূল উদ্দেশ্যই ভুলুন্ঠিত হচ্ছে। শুধুমাত্র সেনাবাহিনী যেদিকে যাচ্ছে সেদিকেই জনশূণ্য থাকছে। আর বন্ধ রয়েছে পরিবহণ সেক্টর। পণ্য পরিবহণ বন্ধ হয়ে পড়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যে নৈরাজ্য নেমে এসেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পণ্য পরিবহণ করতে না পারায় ব্যবসায়ীরা একদিকে পণ্য পাচ্ছে না। অন্যদিকে আগে আনা পণ্য পঁচতে শুরু করেছে। ফলে লোকসান কাটাতে মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে।
সোমবার (৫ জুলাই) সকালে চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দার হাট. রিয়াজউদ্দিন বাজার, কাজির দেউড়ি ও চকবাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে প্রতি কেজি ঢেঁড়স-পটল-লাউ ৬০ টাকা, বেগুন-করলা ৬০-৭০ টাকা, টমেটো-বরবটি-তিত করলা ১০০ টাকা, কাঁচামরিচ ৮০ টাকা, পেঁপে-মিষ্টি কুমড়া কেজি ৫০ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে। যা লকডাউনের আগে কেজি ১০ থেকে ৪০ টাকা কমে বিক্রয় হয়েছে।
একই সময়ে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকায়। শুকনা মরিচ প্রতিকেজি ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২২০ টাকায়, রসুন ৮০ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকায়, আদা ১০০ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকায়। হলুদ ১৬০ টাকা থেকে বেড়ে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া চিনি প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায়। বোতলজাত সয়াবিন তেল কেজিপ্রতি বেড়ে ১৪৮-১৫০ টাকায়, মসুর ডাল বড়ে ১৪০ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে। প্রতিকেজি সোনালি মুরগি ২১০-২২০ টাকা, ব্রয়লার ১৪০, লেয়ার মুরগি ২৫০ টাকায়, প্রতিকেজি খাসির মাংস ৮০০ টাকা এবং গরুর মাংস ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাছের মধ্যে প্রতিকেজি রুই মাছ ২৫০-২৭০ টাকা, চিংড়ি ৫০০-৭০০ টাকা, কাতলা মাছ ২৮০-৩৫০ টাকা, তেলাপিয়া ১৫০-১৬০ টাকা, সিলভার কাপ ১৬০ থেকে ২০০ টাকা, রূপচাঁদা ৬০০ টাকা, সাগরের লাক্ষ্না ও কোরাল ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া ৫০ কেজির প্রতিবস্তা মিনিকেট চাল ১০০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রয় হচ্ছে। যা কেজি হিসেবে ৬০-৬৮ টাকা, মোটা চাল ৪৮-৫৪ টাকা, পোলাওয়ের চাল ১০০-১৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রয় হচ্ছে।
বহদ্দার হাটের চাল বিক্রেতা মক্কা রাইচের মালিক অজিত সাহা এ প্রসঙ্গে বলেন, লকডাউনের কারণে পাহাড়তলীর আড়ত থেকে চাল আনা বন্ধ হয়ে গেছে। দোকানে যা আছে তা বাড়িয়ে বিক্রী করছি। তা না হলে দোকান ভাড়া, কর্মচারির বেতন দিতে পারব না। নিজের সংসারও চলবে না। একই কথা বলেছেন নগরীর কাজীর দেউড়ি বাজারের শাহ আমানত ষ্টোরের মালিক রবিউল ইসলাম ও চকবাজারের মাছ ব্যবসায়ী মো. হারুন। তারা বলেন, লকডাউনে ফলে পণ্য পরিবহণ বন্ধ থাকায় আমদানি নেই। তাই যা আছে তা বাড়িয়ে বিক্রী করতে হচ্ছে।
এদিকে লকডাউনের কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র চাক্তাই-খাতুনগঞ্জেও স্থবিরতা নেমে আসার কথা জানিয়েছেন খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিয়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ স¤পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস। তিনি বলেন, লকডাউনে গত তিন দিনে চট্টগ্রামের সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অভিজাত বিপনি, হোটেল-মোটেল, চা-দোকান খোলা রয়েছে। চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও খোলা। কিন্তু নেই কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য।
লকডাউনে শুধুমাত্র পণ্য পরিবহণ বন্ধ থাকায় কোন ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। এই চাক্তাই খাতুনগঞ্জে যেখানে প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার পণ্য বেচাকেনা হত এখন তা কয়েক কোটিতে নেমে এসেছে। এই কয়েক কোটি টাকার পণ্যও অনেক কৌশলে ভোর রাতে ভ্যানগাড়ি বা ঠেলাগাড়ি দিয়ে বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। এভাবে আর কয়েকদিন চললে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে খেয়ে না খেয়ে জীবন বাচাতে হবে।
তিনি বলেন, লকডাউনে যেখানে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। সেখানে টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় গত বুধবার থেকে পুরো চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ পানিতে তলিয়ে গেছে। বিভিন্ন গুদাম ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। এখানকার নালা-নর্দমাগুলো দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার করা হয়নি। তাই বৃষ্টির পানি চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এছাড়া অবৈধ দখলদারের কবলে পড়ে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে চাক্তাই খালের দুই পাড়। কোথাও কোথাও খালটি ৮-১০ ফুটের মতো সরু হয়ে গেছে। অন্যদিকে তলা পাকা করার ফলে চাক্তাই খাল স্থায়ীভাবে নাব্যতা হারিয়েছে। বর্ষা মৌসুমে এই অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের দুঃখে পরিণত হয় খালটি। অপরদিকে গত তিন বছরেও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) স্লুইচগেট নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেনি। উল্টো নির্মাণ কাজের জন্য চাক্তাই ও রাজখালী খালের বিভিন্ন অংশে বাঁধ দিয়েছে। এতে পানি চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে নিন্মাঞ্চল হাঁটু পানি পর্যন্ত ডুবে যায়। এসব এলাকার বেশ কিছু দোকান গুদামে পানি প্রবেশ করায় প্রায় কয়েক কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে নেওয়া প্রকল্প দ্রুত শেষ করার দাবি জানান তিনি।
খাতুগঞ্জের ব্যবসায়ী আরমান হোসেন বলেন, লকডাউনের কারণে ক্রেতা সংকটে রয়েছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। এছাড়া সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা নাজুক হয়ে পড়ায় দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর ও জেলা শহর থেকে পণ্য আসেনি। কোরবানির ঈদ উপলক্ষে যেখানে ব্যবসা-বাণিজ্যে চাঙাভাব থাকার কথা, সেখানে ব্যবসায়ীরা বিক্রির চেয়ে মজুত পণ্য বাঁচানোর চেষ্টা করছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে পেঁয়াজ, আদা, রসুনের। গত তিন দিনে কোটি টাকার পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে খাতুনগঞ্জে।
তিনি আরও বলেন, দেশের ভোগ্যপণ্যের বড় একটি অংশ চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ থেকে সরবরাহ করা হয়। এষানকার তিন সহস্রাধিক দোকান-গুদামে দিন-রাত সমানে চলে বেচাকেনা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে ট্রাকবোঝাই করে ভোগ্যপণ্য নিয়ে যান। কিন্তু লকডাউনের কারণে গত বুধবার থেকে চট্টগ্রামের বাইরের ক্রেতারা আসতে পারছেন না। আবার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও মালামাল আসছে না। চিনি, ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা, ডাল, ছোলা, চাল, তৈরি পোশাক, কাপড়, কাগজ, ঢেউটিন, রড-অ্যাঙ্গেল, মশলা, ক্রোকারিজ, ওষুধ, কেমিক্যাল, মোটর পার্টস, স্যানিটারি ওয়্যার, জুতা, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স পণ্যসহ সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে।
সাজ্জাদ/কাইয়ুম