ধর্ম ডেস্ক:
চাঁদে পৃথিবীর মানুষ অবতরণ করার দাবি— ওঠেছে বহু আগে। সম্প্রতি খুলনার এক ব্যক্তি বিবাহ বার্ষিকীতে স্ত্রীকে উপহার হিসেবে চাঁদে জমি কিনে দেওয়ার দাবি করেছেন। এমন বিচিত্র এক খবরে হইচই পড়ে গিয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সংবাদমাধ্যও কোনো অংশে পিছিয়ে ছিল না। খবরটি রীতিমতো ভাইরাল হয়েছে। ওই ক্রেতার দেখাদেখি অনেকেই নিজের নামে কিংবা স্ত্রীর জন্য চাঁদে জমি কিনতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এতো আলোচনার ভিড়ে একটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আসে— আর তা হলো- চাঁদে কি আসলেই জমি কেনা যায়, নাকি সবটাই মিথ্যা? আর কেনা গেলেও কি চাঁদে জমি কেনা জায়েজ?
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, চাঁদ ও সূর্য মহান আল্লাহর নিদর্শন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে আছে রাত ও দিন, সূর্য ও চাঁদ। তোমরা সূর্যকে সিজদা কোরো না, চাঁদকেও নয়—সিজদা করো আল্লাহকে, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা শুধু তাঁর ইবাদত করে থাকো।’ (সুরা : হা-মিম সাজদা, আয়াত : ৩৭)
আদৌ চাঁদে জমি কেনা কি সম্ভব?
চাদের জমি কেনা যদি সম্ভব হয়, ইসলামের দৃষ্টিতে তা কি জায়েজ? এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনেই। এ জন্য প্রথমে জানতে হবে, যারা চাঁদে জমি বিক্রি করছে, তারা কিসের ভিত্তিতে জমি বিক্রি করছে?
স্নায়ুযুদ্ধের সময় মহাকাশ অভিযান শুরুর পর পরই মহাকাশের নানা বস্তুর মালিকানার বিষয়টি একটি ইস্যু হয়ে ওঠে। যখন নাসা তাদের প্রথম মনুষ্যবাহী মহাকাশযান চাঁদে পাঠানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তখন জাতিসংঘে ‘বহির্জগতের মহাকাশ চুক্তি’ বা ‘দ্য আউটার স্পেস ট্রিটি’ নামের একটি চুক্তিপত্র গ্রহণ করা হয়। ১৯৬৭ সালের সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য। সেখানে বলা হয়, পৃথিবীর বাইরের মহাশূন্যে, চাঁদ ও অন্য যেসব বস্তু আছে, সেখানে কোনো দেশ দখল বা অন্য কোনোভাবে নিজেদের সম্পত্তি বলে দাবি করতে পারবে না।
চাঁদের মালিকানা দাবি করতে পারা ও না পারা
কিন্তু এই চুক্তিতে একটা বড় ফাঁক থেকে যায়। সেখানে লেখা ছিল, কোনো রাষ্ট্র চাঁদের মালিকানা দাবি করতে পারবে না; কিন্তু কোথাও এটা বলা নেই যে কোনো সাধারণ মানুষ মালিকানা দাবি করতে পারবে কি না! এই অজুহাত কাজে লাগিয়ে ডেনিস হোপ নামক এক আমেরিকান চাঁদের জমির মালিকানা দাবি করে বসেন।
পুরোটাই সাজানো ও আলোচনায় আসার ফাঁদ
অনেকের দাবি, আসলে পুরোটাই তাঁর সাজানো। সাংবাদিকরা তাঁর কাছে চাঁদের দলিল দেখতে চাইলে তিনি নিজের বানানো একটি দলিল দেখান, যেখানে অনেক বানান ও ব্যাকরণগত ভুল আছে। আসল দলিল তিনি সুরক্ষিত রেখেছেন বলে দাবি করেন। তাঁর অঞ্চলের মেয়রের অফিসে জানতে চাওয়া হলে তারা এ সম্পর্কে কিছু জানে না বলে দাবি করেছেন। (সূত্র : shorturl.at/enBF7 ও shorturl.at/bqJX6)
বোঝা গেল, চাঁদের জমি ক্রয়-বিক্রয়ে প্রতারণার আশঙ্কা আছে। ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরনের প্রতারণামূলক ক্রয়-বিক্রয় জায়েজ নেই। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘প্রতারণামূলক ক্রয়-বিক্রয় করতে এবং কাঁকর নিক্ষেপে ক্রয়-বিক্রয় করতে রাসুল (সা.) নিষেধ করেছেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২৩০)
ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেছেন, ‘প্রতারণামূলক ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে আছে পানির মধ্যের মাছ, পলাতক গোলাম, শূন্যে উড়ন্ত পাখি বা অনুরূপ পর্যায়ের কোনো কিছুর ক্রয়-বিক্রয়।’
প্রতারণামূলক ক্রয়-বিক্রয় ইসলামে জায়েজ নেই
ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরনের বেচাকেনাকে ‘বাই-বাতিল’ বলা হয়। যে ক্রয়-বিক্রয় মূলগত ও গুণগত উভয় দিক থেকে শুদ্ধ নয়, তাকে ‘বাই-বাতিল’ বলা হয়। ‘বাই-বাতিল’-এর মোট ছয়টি প্রকার আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো—
এক. হস্তান্তর অযোগ্য বস্তু ক্রয়-বিক্রয় : যে পণ্য হস্তান্তর করা যায় না তার বিক্রি বাতিল বলে গণ্য হবে। যেমন—উড়ন্ত পাখি, পানির মাছ, ছিনতাইকৃত সম্পদ ও দখলহীন সম্পত্তি বিক্রি করা জায়েজ নয়। দুই. প্রতারণামূলক ক্রয়-বিক্রয় : বস্তুর গুণাগুণ গোপন করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে কোনো বস্তু বিক্রয় করা বৈধ নয়।
বর্তমানে চাঁদে জমি বিক্রয়ের যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় তাতে উপরোক্ত শর্তগুলো মেনে চাঁদের জমি হস্তান্তর করা সম্ভব নয়। ডেনিস হোপ কর্তৃক চাঁদের মালিকানা দাবি ও বিক্রয়ের ব্যাপারে প্রতারণার অভিযোগ আছে এবং প্রতারণার আশঙ্কা আছে। মানুষের জন্য চাঁদে যাতায়াত সহজ হয়নি যে— তারা চাঁদে গিয়ে তাদের ক্রয়কৃত জমি হস্তগত করে নেবে। অতএব এখনো ইসলামী আইন মেনে চাঁদে জমি কেনার পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। যদি কখনো ইসলামে ক্রয়-বিক্রয়ের সব শর্ত মেনে চাঁদের জমি হস্তান্তর করা ও হস্তগত করা সম্ভব হয়, মানুষের যাতায়াত সহজ হয়, সেখানে মানুষের অবস্থান করা সম্ভব হয়, তখন চাঁদের জমি ক্রয়-বিক্রয়ের জায়েজ কোনো পদ্ধতি বের করা সম্ভব হবে।
বিএসডি/আইপি