নিজস্ব প্রতিবেদক:
ডিজিটাল এমএলএমে অন্তত ৪১০ কোটি টাকা গায়েব হয়েছে। গত বছরের জানুয়ারিতে ঘরের নিত্যপণ্য অনলাইনে সরবরাহের কথা বলে ব্যবসা শুরু করে এসএম গ্রুপ। পুরো নাম সোশ্যাল মিশন। কিছুদিন চাল, ডাল ও তেল সরবরাহের পর আইডি বিক্রি শুরু করে। www.smshare1.com নামের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রতি আইডির দাম ধরা হয় ১ হাজার টাকা করে। গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ৩০ লাখের বেশি আইডি বিক্রি করে বিভিন্নজনের কাছে। এভাবে ৪ লাখের বেশি আইডি বিক্রি করে এসএম গ্রুপ বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ৪১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তথ্যানুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। তবে ওই অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় গতকাল রাজধানীর ভাটারা থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে এসএম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সোহরাব হোসেন ওরফে শুভ চৌধুরী, তার স্ত্রী নাজমুন্নাহার, এসএম গ্রুপে কর্মরত সাইদুর রহমান ওরফে সোহেল, ওই প্রতিষ্ঠানের আইটি ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ এবং সোহরাবের বডিগার্ড ইমনকে। এদের মধ্যে সাইদুর রহমান ওরফে সোহেলকে গ্রেফতার করে গতকাল আদালতে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন এ প্রতিবেদককে জানান, মাত্র দুই মাসে চক্রটি ৪১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ১০০ দিনে টাকা দ্বিগুণ করে দেওয়ার কথা বলে প্রলোভন দেখাত তারা। এ ছাড়া কারও মাধ্যমে কোনো আইডি বিক্রি করলে তাকেও কমিশন দেবে বলে অফার দেয়। যেহেতু আইডির দাম কম তাই সহজে অনেককে ফাঁদে ফেলতে পেরেছে চক্রটি।
তিনি বলেন, এরা কোনো অফিস নিত না। গাড়িতেই মোবাইল অফিস ছিল। সেখানে কাগজপত্র, চা-কফি সবকিছুর ব্যবস্থা ছিল। যদি কেউ যোগাযোগ করতে চাইত, তার স্থানে গিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে আলোচনা করত এবং টাকা নিয়ে চা-নাশতা খাইয়ে নির্দিষ্ট স্থানে নামিয়ে দিত। সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, চক্রটির হোতা সোহরাবকে ধরতে শনিবার অভিযান চালায় সিআইডি। ক্রেতা সেজে সংস্থাটির কয়েকজন সদস্য তার গাড়িতে উঠে পড়ে। চলন্ত গাড়িতে কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে সিআইডি সদস্যরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে গাড়ি থামাতে বললে সোহরাব তা আইল্যান্ডের ওপর উঠিয়ে দেন। এতে সিআইডি সদস্যরা গুরুতর আহত হলে এ সুযোগে সোহরাব ও তার সহযোগীরা পালিয়ে যান। এ সময় টয়োটা এলিয়ন ব্র্যান্ডের একটি সাদা গাড়ি, ৯টি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন, ২০টি সিল, তিনটি লোহার হাতুড়ি, ১টি হকিস্টিক, ১টি বেজবল স্টিক, ছয়টি রেজিস্টার, ডিলার নিয়োগের চুক্তিপত্র এবং ১২০টি চাবি জব্দ করা হয়েছে। এদিকে গতকাল রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে অন্তত ২৩ জন ভুক্তভোগী নিজেদের অভিযোগ জানাতে আসেন। এদের মধ্যে অন্যতম হাবিবুর রহমান ও মাইনুল ইসলাম। হাবিবুর বাদী হয়ে গতকাল ভাটারা থানায় মামলা করেছেন।
হাবিবুর জানিয়েছেন, শুরুতে চক্রটি ১ হাজার টাকায় কেনা আইডির বিনিময়ে চাল, ডাল, তেল, হলুদ ও মরিচ সরবরাহ করে আস্থা অর্জন করে। এরপর ননপ্রডাক্ট আইডি ৭০০ টাকায় বিক্রি করতে থাকে। ১০০ দিনে দ্বিগুণ হওয়ার প্রলোভনে গত বছর ৮ জানুয়ারি তিনি ২০০টি আইডি কেনেন। এরপর আইডিগুলোর দাম ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা হয়ে যাচ্ছে শুনে আরও ৫০০টি আইডি কেনেন। মোট ৭০০টি আইডি কিনতে তার ৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তাদের ওয়েবসাইটে হাবিবুরের আইডিগুলো প্রদর্শন করা হয়। প্রতিদিন আইডিপ্রতি ২০ টাকা করে বাড়তে থাকে। প্রথম দিকে সফটওয়্যারে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা না হলে কথিত সরকারি নিয়মের কথা বলে তার মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করত না চক্রের সদস্যরা। সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, হাবিবুরের মতো আরও অনেকে আইডি কেনা শুরু করলে এসএম গ্রুপ ঘোষণা দেয়, ৩০০টি আইডি কিনলে ন্যাশনাল মেম্বারশিপ দেওয়া হবে। এ ছাড়া আরও ১০ হাজার টাকা এবং ছয় মাসব্যাপী প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে। এই লোভনীয় অফারে যশোরের মামুনুর রশীদ ৩০০টি আইডি কেনেন। এক মাস পর তাকে এসএম গ্রুপ মাত্র ৯ হাজার টাকা দেয়। এরপর আর কোনো টাকা দেয়নি। www.smshare1.com নামের ওয়েবসাইটে মামুন তার আইডি-পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করে দেখেন, তার আইডির বিপরীতে প্রতিদিন ২০ টাকা করে যোগ হচ্ছে। অথচ তাকে টাকা দেওয়া হচ্ছে না এবং তার মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টেও টাকা আসছে না। মামলায় হাবিবুর জানান, আইডির বিপরীতে তার টাকা না পাওয়ার বিষয়ে সোহরাবের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি তাকে বলেন, ‘এভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েই সবাই বড়লোক হয়েছে।’ উল্টো তাকে নতুন কাউকে দিয়ে আইডি কেনাতে এবং টাকা সংগ্রহের পরামর্শ দেন সোহরাব। এ ছাড়া আগের জমা দেওয়া টাকা ফেরতের সম্ভাব্য দিন-তারিখ জানিয়ে দেন।
তার মতো মাইনুলের কাছ থেকে অন্তত ৮০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন এমএম গ্রুপের এমডি সোহরাব। এই চক্র বিভিন্নজনের কাছ থেকে লোভনীয় অফারের টাকা নিয়ে উত্তরা, বিমানবন্দর, ভাটারা ও বনানী এলাকায় আসতে বলে। টাকা নিয়ে নির্ধারিত স্থানে গ্রাহকদের কাছে সোহরাবের চক্র ঢাকা মেট্রো গ-২২-৩৬১১ এবং ঢাকা মেট্রো গ-৩৭-০০৪৩ নম্বরের গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হয়। গত বছরের শেষের দিকে চক্রটি গাড়িতে গ্রাহকদের তাড়াহুড়ো করে উঠিয়ে হাতুড়ি, হকিস্টিক দেখিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে টাকা-পয়সা নিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিত বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। সিআইডির ঢাকা মেট্রো উত্তরের বিশেষ পুলিশ সুপার খালিদুল হক হাওলাদার জানান, চক্রটি ডিলারশিপ নিয়োগ, অনলাইন আইডি ও কোম্পানির শেয়ার বিক্রি, চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা এবং এজেন্সির নামে প্রতারণা করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে আসছে।
বিএসডি /আইপি