আত্মহত্যা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। সারা বিশ্বে আত্মহত্যা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে জনসচেতনতা বাড়াতে আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যৌথ প্রয়াসে প্রতিবছরের ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালন করে। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো ‘ওয়ার্কিং টুগেদার টু প্রিভেন্ট সুইসাইড’, অর্থাৎ ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করি একসঙ্গে’।
আত্মহত্যার কারণ:
একজন মানুষ নানা কারণে আত্মহত্যা করতে পারেন। এর মধ্যে ব্যক্তিত্বে সমস্যা, ঘোরতর মানসিক রোগ বা স্বল্পতর মানসিক, মাদকাসক্তি, এনজাইটি, ডিপ্রেশন অথবা প্ররোচনা ইত্যাদি।
ছেলেদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি হলেও বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে এই হার অধিক। সাধারণত কম বয়সী মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবনতা সবচেয়ে বেশি। স্বল্পশিক্ষা, দারিদ্র্য, দাম্পত্য কলহের জন্যে অনেকে আত্মহত্যা করে। এ ছাড়াও প্রেম-সম্পর্কিত জটিলতা, আর্থিক অনটন, দীর্ঘস্থায়ী রোগ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ।
যেসব মাধ্যমে আত্মহত্যার করে:
গ্রামের সাবসেন্টারে কিংবা উপজেলা হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে অনেক চিকিৎসককে আত্মহত্যার রিপোর্ট লেখতে হয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ মহিলা পুরুষ আত্মহত্যা করেন কীটনাশক পান করে। তাছাড়া গলায় দড়ি প্যাঁচিয়েও অনেককে আত্মহত্যা করতে দেখা যায়। এ দৃশ্য অত্যন্ত ভয়াবহ ও হৃদয় বিদারক। আত্মীয় স্বজনদের কান্না আহাজারি আর বিলাপে হাসপাতাল ভারী হয়ে ওঠে।
প্রতি বছর বাংলাদেশে এক লাখেরও অধিক নারী পুরুষ আত্মহত্যা করেন। আর বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখ পুরুষ ও মহিলা আত্মহত্যা করে যা যে কোন যুদ্ধে নিহতের চেয়েও অনেক বেশি। সে হিসেবে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১ জন নারী বা পুরুষ আত্মহত্যা করছেন।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কম বয়সী মেয়েদের মধ্যে এই আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। কেউবা মা বাবার উপর অভিমান করে, কেউবা পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করাতে আবার কারো কারো কারন থাকে অজানা। তবে বেশির ভাগ আত্মহত্যা করেন ডিপ্রেশনের জন্যে।
ডিপ্রেশন কী:
ডিপ্রেশন একটি ভয়াবহ মানসিক ব্যাধি যা একজন মানুষকে সবার অজান্তে তিলেতিলে শেষ করে দেয়। মানুষের শারীরিক মানসিক কর্মক্ষমতা ও মারাত্মক কমিয়ে দেয় এই ডিপ্রেশন। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় তিনশ মিলিয়ন ডিপ্রেশনের রোগী রয়েছেন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি ৫ জনের ১ জন মানুষ কোন না কোন ধরনের ডিপ্রেশন বা এনজাইটিতে ভুগছেন।
অনেক ক্ষেত্রেই পারিবারিক বা সামাজিক সম্পর্কের অবনতি এই ডিপ্রেশনের জন্যে হয়ে থাকে, যা হয়ত থেকে যায় একেবারে অজানা। আবার উল্টোটিও হয়। পারিবারিক বা সামাজিক টানাপোড়েন থেকেই অনেক সময় মানুষ ডিপ্রেশনে ভুগেন।
শুরুতেই বলেছিলাম, ডিপ্রেশনের ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে আক্রান্ত রোগীরা নিরবে নিভৃতে আত্মহত্যা করে বসেন। এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে বিশ্বের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ তরুণী দের আত্মহত্যার প্রধান কারণ এই ডিপ্রেশন। ডিপ্রেশন বেশি দেখা যায় মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। অনেকক্ষেত্রে ডিপ্রেশন থেকে ডায়াবেটিস ও হাইপ্রেশার হয়ে থাকে। ডিপ্রেশন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। অনেক ক্ষত্রে বৃদ্ধ, শিশু, কিশোর এমনকি সন্তান সম্ভবা মা কিংবা প্রসুতি মায়েদের ও ডিপ্রেশন দেখা দেয় যা থেকে তারা আত্মহত্যা করে বসেন।
বাংলাদেশের শতকরা ১৮ থেকে ২০ ভাগ মানুষ কোন না কোন প্রকারের ডিপ্রেশন বা এনজাইটিতে ভুগছেন। যাদের পরিবারের অনেকে হয়তো জানেনই না যে, তারা ডিপ্রেশনের রোগী, চিকিৎসা তো দুরের কথা। তবে আমার মতে সংখ্যাটা হয়তো আরো বেশি হবে কেননা এখনো আমাদের অনেকেই আছে ডিপ্রেশনকে কোন রোগই মনে করেন না। কিংবা ডিপ্রেশন নিয়ে সচেতন না।
যেসব বিখ্যাত ব্যক্তি ডিপ্রেশনের রোগী ছিলেন:
বিশ্বের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ডিপ্রেশনের রোগী হওয়া সত্বেও চিকিৎসা ও কাউন্সেলিংয়ে ডিপ্রেশনকে কাটিয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে আব্রাহাম লিংকন, চাঁদে ভ্রমণকারী এডুইন অলড্রিন, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, উইস্টন চার্চিল, বিখ্যাত ‘হ্যারি পটার’ এর লিখিকা জে কে রাওলিং, গ্রেমী এওয়ার্ড খেতাব প্রাপ্ত গায়িকা শেরিল ক্রো, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের স্ত্রী টিপের গোর নাম উল্লেখ যোগ্য।
মার্কিন নভোচারী অলড্রিনের দাদা দাদি ও ডিপ্রেশনের রোগী ছিলেন যারা এ নিয়ে আত্মহত্যা করেন এবং হ্যারি পটারের লেখিকা রাওলিং এক সময় ডিপ্রেশনের জন্যে মাঝেমধ্যে আত্মহত্যার কথা ভাবতেন। তবে তারা নিয়মিত সাইকিয়াট্রিস্ট সাথে আলোচনা করেন।
ডিপ্রেশনের রোগীদের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে, তাদের সাথে ডিপ্রেশন নিয়ে আলাপ করতে হবে এবং তাদের চিকিৎসার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। ইদানীং অনেক মেডিকেল স্টুডেন্টকেও ডিপ্রেশন থেকে আত্মহত্যা খবর পাওয়া যাচ্ছে।
ডিপ্রেশনের লক্ষণ:
আসুন জেনে নেই ডিপ্রেশনের প্রধান কিছু লক্ষণ;
– সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকা
– উৎসাহ উদ্যম হারিয়ে ফেলা
– ঘুমের কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া
– রুচি কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া
– ওজনের কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া
– কাজ কর্মে শক্তি না পাওয়া
– মনোযোগ হারিয়ে ফেলা
– মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া
– নিজেকে নিঃস্ব অপাংক্তেয় মনে করা
– অযাচিত অপরাধ বোধ
– আত্মহত্যার কথা বলা, ভাবা।
এই লক্ষণগুলো টানা দু’সপ্তাহের বেশি থাকলে আমরা তাকে মেজর ডিপ্রেশনের রোগী বলি এবং তিনি আত্মহত্যার ঝুকিতে আছেন বলা যায়।
চিকিৎসা:
সাইকিয়াট্রিস্টের তত্ত্বাবধানে থেকে নানান প্রকারের কার্যকরী এন্টিডিপ্রেসেন্ট ড্রাগ সাইকোথেরাপি ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে একজন ডিপ্রেশনের রোগীকে সম্পূর্ণ রুপে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। সাধারণত এমিট্রিপটাইলিন, সিটালোপ্রাম, এস সিটালোপ্রাম, মিরটাজাপিন এন্টি ডিপ্রেশন হিসেবে খুবই কার্যকরী।
সারা বিশ্বে ক্রমবর্ধমান ডিপ্রেশনের এই ভয়াবহতা উপলব্ধি করেই গত বছরের ৭ই এপ্রিল (২০১৭) বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগান করা ছিলো, ‘ডিপ্রেশন: লেট’স টক’ অর্থাৎ ‘আসুন, ডিপ্রেশন নিয়ে আলোচনা করি।’
সবশেষে আবারও বলছি, ডিপ্রেশনের রোগীরা সবার অগোচরে আত্মহত্যা করে বসেন। তাই তাদের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলুন, সময় দিন এবং বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হোন।
ডা. মুহাম্মাদ সাঈদ এনাম ওয়ালিদ
চিকিৎসক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কলামিস্ট, জনস্বাস্থ্য গবেষক।
বিএসডি/এমএম