রাশিয়ার বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির স্বাস্থ্যের অবনতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক একদল বিশেষজ্ঞ। এ প্রেক্ষাপটে কারাবন্দী নাভালনিকে চিকিৎসার জন্য জরুরি ভিত্তিতে রাশিয়া থেকে বাইরের দেশে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
জাতিসংঘের চারজন স্বাধীন বিশেষজ্ঞ গতকাল বুধবার নাভালনির স্বাস্থ্যের অবনতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এই চারজন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ। তাঁরা জাতিসংঘ কর্তৃক নিযুক্ত হলেও সংস্থার পক্ষে এসব কথা বলেননি।
জাতিসংঘের চার বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, নাভালনির জীবন গুরুতর বিপদে রয়েছে।’
এ অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার জন্য নাভালনিকে রাশিয়ার বাইরে নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা। নাভালনিকে বিদেশে নেওয়ার অনুমতি দিতে রাশিয়ার কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান তাঁরা।
একই সঙ্গে জাতিসংঘের চার বিশেষজ্ঞ বলেন, কারাবন্দী অবস্থায় নাভালনির জীবন ও স্বাস্থ্যগত যেকোনো অবস্থার জন্য রুশ সরকার দায়ী থাকবে। একই কথা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও বলেছে।
জাতিসংঘের চার বিশেষজ্ঞের আগে গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্র কারাবন্দী নাভালনির সঙ্গে অবিলম্বে স্বাধীন চিকিৎসকদের সাক্ষাতের অনুমতি দিতে রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানায়।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলেন, নাভালনিকে এমন পরিস্থিতিতে রাখা হচ্ছে, যা নির্যাতন বা নিষ্ঠুরতা, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তির মতো বিষয় হিসেবে গণ্য হতে পারে। এতে তাঁরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
এমন এক সময় জাতিসংঘের চার বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে নাভালনি ইস্যুতে মন্তব্য এল, যখন তাঁর সমর্থকেরা রাশিয়াজুড়ে বিক্ষোভ করছেন।
বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, নাভালনির সমর্থনে স্থানীয় সময় গতকাল বুধবার রাশিয়ায় হাজারো মানুষ বিক্ষোভ করছেন। দেশটির কর্তৃপক্ষ এই বিক্ষোভকে ‘অবৈধ’ হিসেবে অভিহিত করলেও তা গায়ে লাগাননি বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভ ভন্ডুল করতে গ্রেপ্তারসহ নানা তৎপরতা চালাচ্ছে রুশ পুলিশ। বিক্ষোভ ঘিরে রাশিয়াজুড়ে এক হাজারের বেশি লোককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে জানিয়েছে দেশটির স্বাধীন পর্যবেক্ষক সংস্থা ওভিডি-ইনফো।
রাজধানী মস্কোসহ রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হচ্ছে মস্কোয়।
বিক্ষোভকারীরা নাভালনিকে কারাবন্দী করার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। তাঁরা নাভালনির মুক্তি দাবি করছেন। তাঁর যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছেন।
এক বিক্ষোভকারী বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, তিনি নাভালনির জন্য বিক্ষোভে এসেছেন। রাশিয়াকে মুক্ত করার এটাই সুযোগ। আরেকজন বিক্ষোভকারী বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, এটা তাঁদের ভবিষ্যতের জন্য লড়াই।
গতকালের বিক্ষোভ সামনে রেখে আগেই নাভালনির শীর্ষ সহযোগী লুবভ সোবোলকে আটক করে রুশ পুলিশ। তিনি ছাড়া আরও অনেকে বিক্ষোভের প্রাক্কালে আটক হন।
৪৪ বছর বয়সী নাভালনি রাশিয়ার একজন সুপরিচিত বিরোধী নেতা। তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কট্টর সমালোচক হিসেবে পরিচিত। নাভালনি বর্তমানে রাশিয়ায় কারাগারে আছেন।
নাভালনি গত ৩১ মার্চ থেকে কারাগারে অনশন শুরু করেন। পিঠে তীব্র ব্যথা ও পায়ের অসাড়তার জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা না পেয়ে তিনি অনশনে যান।
নাভালনির পরিবার, চিকিৎসক, আইনজীবী ও সহযোগীরা কিছুদিন ধরে বলে আসছেন, তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো নয়। তাঁর অবস্থা এমন যে তিনি মারা যেতে পারেন। নাভালনির স্বাস্থ্য নিয়ে দেশ-বিদেশে উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে তাঁকে গত সোমবার একটি কারা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
রাশিয়ার কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, ভ্লাদিমির অঞ্চলের একটি কারাগারের বিশেষায়িত হাসপাতালে নাভালনিকে স্থানান্তর করা হয়েছে। তাঁর বর্তমান স্বাস্থ্যগত অবস্থার মূল্যায়নের ফল সন্তোষজনক। নাভালনির সম্মতির ভিত্তিতে তাঁকে ভিটামিন থেরাপির পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক।
তবে নাভালনিকে ঠিক কী চিকিৎসাপত্র দেওয়া হয়েছে, চিকিৎসাপত্রে তাঁর সম্মতি আছে কি না, সে সম্পর্কে এই বিরোধী নেতার ব্যক্তিগত চিকিৎসক বা প্রতিনিধিরা কিছুই জানেন না।
নাভালনির সমর্থকেরা বলছেন, তাঁর অবস্থাসম্পর্কিত তথ্য কর্তৃপক্ষ তাঁদের কাছে গোপন করছে। এ ছাড়া যে কারা হাসপাতালে নাভালনিকে স্থানান্তর করা হয়েছে, সেটি গুরুতর অসুস্থ যক্ষ্মা রোগীদের চিকিৎসার বিশেষায়িত হাসপাতাল।
নাভালনিকে গত বছরের আগস্টে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সে সময় তিনি সাইবেরিয়ার টমসক শহর থেকে উড়োজাহাজে করে মস্কোয় ফিরছিলেন। যাত্রাপথে উড়োজাহাজেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে বহনকারী উড়োজাহাজ সাইবেরিয়ার ওমস্কে জরুরি অবতরণ করে। সেখানকার একটি হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। তিনি কোমায় চলে গিয়েছিলেন। পরে তাঁকে চিকিৎসার জন্য জার্মানির বার্লিনে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি ধীরে ধীরে সেরে ওঠেন।
বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে গত সেপ্টেম্বরে জার্মানি জানায়, নাভালনিকে রাশিয়ান নার্ভ এজেন্ট ‘নোভিচক’ প্রয়োগ করা হয়েছিল। পরে অন্য দেশের বিশেষজ্ঞরাও একই কথা বলেন। বিষ প্রয়োগের জন্য সরাসরি পুতিনকে দায়ী করেন নাভালনি। তবে পুতিন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বানে ক্রেমলিন কর্ণপাত করেনি।
ক্রেমলিনের হুমকি উপেক্ষা করে গত ১৭ জানুয়ারি দেশে ফেরেন নাভালনি। বিমানবন্দরেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। অর্থ আত্মসাতের পুরোনো একটি মামলায় গত ফেব্রুয়ারি মাসে নাভালনিকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই দণ্ডকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করেছেন নাভালনি।