পরকীয়া ! একটি নিষিদ্ধ সম্পর্কের নাম। দাম্পত্য জীবনে পরকীয়া সবচেয়ে জটিল সম্পর্কের একটি। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের অমোঘ আকর্ষণ থাকে। বলতে গেলে এটি মানুষের প্রকৃতিজাত অভ্যাস। পরকীয়া নামের অসামাজিক বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের অশুভ প্রলয়ে ধ্বংসের মুখে আজ পরিবার প্রথা।
নিষেধাজ্ঞা পেলেই যেন বিষয়টির উপর আকর্ষণ বেড়ে যায়। নিষিদ্ধ বলেই পরকীয়া সম্পর্ককে অসামাজিক, অনৈতিক, অধর্মীয়, অবৈধ বলে আখ্যায়িত করা হয়। কারও পরকীয়া সম্পর্ক থাকুক আর না থাকুক বিষয়টা নিয়ে সমাজে বেশ আলোচনা চলে।
অনেকেই সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তা করে নিরবে সহ্য করে যাচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর এই নিষিদ্ধ সম্পর্ক। অনেকেই আবার বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার মতো অভিশপ্ত পথ। কেউ কেউ পরকীয়া নামক নরক যন্ত্রণার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ঘটাচ্ছেন বিবাহ বিচ্ছেদ।
বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৪৯৭ ধারায় ব্যভিচারের শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। এ আইনে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো লোকের স্ত্রী জানা সত্ত্বেও বা সেটা বিশ্বাস করার অনুরুপ কারণ রয়েছে এমন কোনো নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্মতি ছাড়া যৌন সম্পর্কে আবদ্ধ হোন এবং অনুরূপ যৌন সম্পর্ক যদি ধর্ষণের অপরাধ না হয়, তাহলে সে ব্যক্তি ব্যভিচারের দায়ে দায়ী হবেন, যার শাস্তি সাত বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে অথবা অর্থদন্ডে অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা যাবে।
এ ক্ষেত্রে নির্যাতিতাকে অন্য লোকের স্ত্রী হতে হবে। তবে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ব্যভিচারের ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের কোনো শাস্তির বিধান আইনে নেই। ওই স্ত্রীলোকটি যে দুষ্কর্মের সহায়তাকারিণী বা ব্যভিচারের অপরাধে দোষী অথচ তিনি কোনো সাজা পাবে না।
১৮৬০ সালে ইংরেজ শাসনকালে তৈরি তথা প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারাটি বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৩২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এতে নারী ও পুরুষকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয়েছে। যা একজন নারীর জন্য অপমানজনক। এটা সংশোধন প্রয়োজন। আর এই নিয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করা হয়েছে ২০১৯ সালে তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাভিচার সংক্রান্ত দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট।
সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার পাবেন। এছাড়া ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইন ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না।
ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশে ফৌজদারি আইন হিসেবে ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ সরকারের তৈরি করা দণ্ডবিধিই প্রয়োজনমতো বদলে নিয়ে চালু রাখা হয়েছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টও আইনটিকে ‘নারীদের জন্য অপমানজনক’ হিসেবে বর্ণনা করে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ ব্যভিচার আইন ইতোমধ্যে বাতিল করে দিয়েছে উল্লেখ করে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ৪৯৭ ধারাটি বাতিল করে দিলেও বলেছে, ব্যভিচার ‘অপরাধ নয়’!
ভারতীয় সমাজের একটা বড় অংশ এই রায়ের সমর্থক হলেও তবে অনেকেই বলছেন, এই রায়ের ফলে পরিবার ও সমাজ জীবনে নৈরাজ্য দেখা দেবে। ভারতীয় অনেক বিশেষ ব্যক্তিবর্গের মতে, এই রায়ের পরিণাম ভয়ংকর হবে৷ একটা ছেলে বা মেয়ে এ ধরনের স্বাধীনতা পেলে উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন শুরু করবে। ফলে পরিবার জীবনে সংকট তৈরি হবে বলে মনে করেন তাঁরা।
তাঁরা আরও বলেন, ”বহুগামী মহিলার সন্তানের বাবা কে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে৷ ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন পড়বে। এ সকল পরিস্থিতি সন্তানের ভবিষ্যৎ সংকট তৈরি করবে। এছাড়া বহুগামী স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ নিতে চাইলে স্বামীকে বিশাল পরিমাণ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তাঁর সংসারও ভাঙবে, আর্থিক ক্ষতিও হবে।” এছাড়া কিছু বিশেষ ব্যক্তিবর্গ বলেছেন, “পরকীয়া বৈধ হলে সম্পর্কের বাঁধন থাকবে না। সম্পর্কের শাসন না থাকলে তা কিভাবে টিকবে?”
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পরকীয়া আর অপরাধ নয়৷ এই রায়ের মাধ্যমে নতুন বিতর্কের সূত্রপাত৷ অনেকে বলছেন, নারীর অধিকারকে পূর্ণতা দিয়েছে এই রায়। আবার অনেকের মতামত অনুযায়ী, এই স্বাধীনতা পারিবারিক ও সমাজজীবনে ভয়ংকর পরিণাম ডেকে আনবে। বেলা শেষে পরিবার প্রথা কি ভাঙনের পথে এগুবে? আমাদের দেশেও রেকর্ড সংখ্যক পরকীয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে, প্রতিদিন খবরের কাগজে পরকীয়া নিয়ে বিভিন্ন অপরাধের খবর প্রকাশিত হচ্ছে।
মায়ের হাতে শিশু পর্যন্ত হত্যার শিকার হয়েছে। স্বামীর দ্বারা স্ত্রী হত্যার খবর প্রতিনিয়ত শোনা যাচ্ছে। এধরণের অপরাধ সমাজকে কোথায় নিয়ে যাবে আমরা কি একটিবার ভেবে দেখছি? আইন প্রণয়ন করেও কি পরকীয়া/ব্যাভিচার ঠেকানো সম্ভব হবে?
তাই আপনার পরিবারে অশান্তি হলে, কী নিয়ে হচ্ছে। আগে সমস্যাটা বের করার চেষ্টা করুন। তারপর সমস্যা সমাধান করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন। যদি ব্যর্থ হতে হয়, তবে সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা শ্রেয়। অন্তত নিজের কাছে পরিষ্কার থাকুন। তারপর অন্য সম্পর্কে জড়াতে পারেন সেটা আপনার ব্যক্তি স্বাধীনতা।
সমাজ বা কে কী ভাববে তার চেয়েও বড় কথা আপনি নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে নিজে কী চিন্তা করছেন। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে কোন অদৃশ্য ফটক থাকা উচিত নয়। এই রিলেশনটা এমন একটা রিলেশন, যেখানে একজন নিচে নামলে সঙ্গীকেও নামতে হয়। একজন ভালো থাকলে অন্যকেও ভালো রাখতে পারে।
আমার শুধু একটি কথাই সবার প্রতি, জীবনসঙ্গীকে বুঝতে চেষ্টা করুন, সেটা দুজনেই সমভাবে। অনেক সময় হয়ত বুঝতে পারি না। এমনও হতে পারে সঙ্গী আপনাকে অনেক ভালোবাসেন, অনেক চান, কিন্তু লাজুক স্বভাবের জন্য বলতে পারেন না। হয়ত তার এই আনকমফোর্টেবল বিষয়টিকে আপনি অক্ষমতা ধরে নিচ্ছেন।
ভাবছেন আপনাকে মূল্যায়ন করছে না, ভেতরে দূরত্ব চলে আসছে। দুজন দুজনকে সময় দিন। সরাসরি একে অপরের সঙ্গে কথা বলুন। এতে সমাধান হলে আলহামদুলিল্লাহ, নয়ত সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসুন। কিন্তু একই সঙ্গে দুটি সম্পর্কে জড়াবেন না।
এতে প্রতারণা তো হবেই সেই সঙ্গে অনেক সমস্যাও তৈরি হবে। সবচেয়ে বড় কথা নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকুন। সম্পর্কের কাছে সততা নিয়ে থাকুন। এতে করে আপনিও সুস্থ মানসিকতা নিয়ে থাকবেন, আপনার পরিবারের মানুষগুলোও একটি সুন্দর পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে।
লেখক : ব্যারিস্টার জাহিদ রহমান
বিএসডি/জাহিদ/তাওসিফ