নিজস্ব প্রতিবেদক
সদ্য প্রকাশিত এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে সন্তুষ্ট না হয়ে খাতা চ্যালেঞ্জ করা প্রায় ৩ হাজার ৪৭৫ জন পরীক্ষার্থীর ফলাফলে পরিবর্তন এসেছে। তাদের মধ্যে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৯৪ জন। আগের ফলাফলে অনুত্তীর্ণ থাকা পরীক্ষার্থীদের মধ্যে খাতা চ্যালেঞ্জের পর সর্বোচ্চ গ্রেড জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ জন। শুধু তাই নয়, আগের প্রকাশিত ফলাফলে ফেল থাকা পরীক্ষার্থীদের মধ্যে খাতা চ্যালেঞ্জ করে পাস করেছেন ৪১০ জন শিক্ষার্থী।
চলতি বছরের এইচএসসির পুনঃনিরীক্ষণের ফলে এমন অস্বাভাবিক ফল পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। খাতা মূল্যায়নের এই চিত্রকে বিপজ্জনক বলছেন শিক্ষাবোর্ড সংশ্লিষ্টরা।
বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার খাতা পুনঃনিরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে ৯টি সাধারণ এবং মাদ্রাসা বোর্ডের প্রকাশিত পুনঃনিরীক্ষণের ফল বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ফল (সন্ধ্যা ৬টা) এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত প্রকাশ করেনি।
গত ১৫ অক্টোবর চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়। এতে গড় পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মোট জিপিএ-৫ পেয়েছেন এক লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। প্রকাশিত ফলাফলে কোনো শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত ফল না পেলে সে খাতা চ্যালেঞ্জ করার জন্য গত ১৬ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত আবেদন গ্রহণ করা হয়। এরপর আজ পুনঃনিরীক্ষণের ফলাফল প্রকাশিত হলো।
শিক্ষাবোর্ডে কর্মকর্তা বলছেন, চলতি বছর সাতটি পরীক্ষা হওয়ার পর সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছড়িয়ে পড়লে কয়েক দফায় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। পরে বাকি পরীক্ষাগুলো বাতিল করে আগের ফলাফলের সঙ্গে ম্যাপিং করে অটোপাস পাস দেওয়া হয়। ফলে ওই সময়ের বিষয়গুলোতে পরীক্ষা না হওয়ায় খাতা চ্যালেঞ্জের সংখ্যা অনেক কম পড়েছে।
ফল পরিবর্তনের সংখ্যাটি অস্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা। বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর ফলাফল পরিবর্তনের পেছনে পরীক্ষকদের সরাসরি গাফিলতি রয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুনঃনিরীক্ষণে নতুন করে কোনো উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয় না। শুধু উত্তরপত্রে শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বরের যোগ-বিয়োগগুলো দেখা হয়। এতেই এতো সংখ্যক শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। যদি আবার মূল্যায়নের সুযোগ দেওয়া হয় তবে পরিস্থিতি কি হবে প্রশ্ন রেখে তারা বলছেন, শুধু পরীক্ষকদের গাফিলতিতে এমনটা হচ্ছে। এজন্য ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ করার রীতিকে দায়ী করছেন তারা।
এর আগে ২০১৯ সালে টানা তিন বছর ধারাবাহিক গাফিলতির কারণে ১ হাজার ২৬ পরীক্ষককে শাস্তির আওতায় আনে শিক্ষাবোর্ড। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বোর্ডের আইন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অভিযুক্ত বেশিরভাগ পরীক্ষককে কালো তালিকাভুক্ত, কাউকে সারা জীবনের জন্য কোনো বোর্ডের পরীক্ষক হতে না পারার মতো শাস্তি দেওয়া হয়। তবে যেসব পরীক্ষক খাতা মূল্যায়নে কেলেঙ্কারি বা ক্রাইমে যুক্ত হন, তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ এবং চাকরিচ্যুতির নজির রয়েছে। এরপর বিভিন্ন সময় তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা হলেও সংখ্যাটা খুবই কম।
এ ব্যাপারে আন্তঃবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক আবুল বাশার বলেন, এবার সাতটি বিষয়ে পরীক্ষা হয়নি। ফলে খাতা চ্যালেঞ্জ করে ফল পরিবর্তনের সংখ্যাটা অন্যান্য বছরের চেয়ে কম। তারপরও তা অস্বাভাবিক। এর কারণ খতিয়ে দেখা হবে। ফল পরিবর্তন হবে এটি স্বাভাবিক ঘটনা, তবে এই সংখ্যাটি যদি নির্দিষ্ট পার্সেন্টের বাইরে চলে যায় তবে আমাদের চিন্তার বিষয়। নিশ্চয় কোনো জায়গায় সমস্যা হচ্ছে, তা চিহ্নিত করতে হবে।
তিনি জানান, সব বোর্ডের তথ্য সংগ্রহ করে চিহ্নিত পরীক্ষকদের বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেওয়া হবে। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী অভিযুক্ত বেশিরভাগ পরীক্ষককে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। অপরাধের মাত্রা বেশি হলে তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ করার জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়।
কোন বোর্ডে কত জনের ফল পরিবর্তন
ঢাকা বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষার কাঙ্ক্ষিত ফল না পেয়ে ১ লাখ ৮০ হাজার ৬০টি উত্তরপত্র পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করে শিক্ষার্থীরা। তাদের মধ্যে মোট ১ হাজার ৩৩০ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। এতে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন পেয়েছে ২০০ জন আর ফেল থেকে পাস করেছেন ১৩৭ পরীক্ষার্থী। ফেল থেকে নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন একজন।
চট্টগ্রাম বোর্ডে ফলাফল পুনঃনিরীক্ষণের জন্য আবেদন করে মোট ২২ হাজার ৩২৪ পরীক্ষার্থীর ৬৮ হাজার ২৭১টি খাতার আবেদন করেন। এরমধ্যে মোট ৫৫৬ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। এরমধ্যে ফেল থেকে পাস করেছে ১১৯ এবং নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬১ জন।
বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে এ বছর খাতা পুনঃনিরীক্ষণের জন্য ৭ হাজার ২১ শিক্ষার্থী ২৪ হাজার ২৬৫টি খাতা চ্যালেঞ্জ করেছিল। সেখান থেকে মোট ৮৯ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৯ শিক্ষার্থী আর ফেল থেকে পাস করেছে ১ শিক্ষার্থী।
দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডে মোট ১৪ হাজার ৫২৫ পরীক্ষার্থী ৩৭ হাজার ৬৩৯টি খাতা চ্যালেঞ্জ করে। এরমধ্যে মোট ফল পরিবর্তন হয়েছে ৮১ জন শিক্ষার্থীর। তাদের মধ্যে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৮ জন, ফেল থেকে নতুন করে পাস করেছেন ১৬ জন।
রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে ১৫ হাজার ৩৭৮ পরীক্ষার্থী মোট চ্যালেঞ্জ করেন ৩৯ হাজার ২৬৩টি খাতা। এরমধ্যে ফল পরিবর্তন হয়েছে ৯৮ জনের। নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৪ জন। ফেল থেকে নতুন করে পাস করেছে ৩৪ জন।
যশোর বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষার খাতা পুনঃনিরীক্ষণে মোট ৭৯ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। তাদের মধ্যে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৩ জন। আর ফেল থেকে নতুন করে পাস করেছে ৩১ জন। বাকিরা বিভিন্ন গ্রেডের ফল পরিবর্তন হয়েছে।
কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে মোট ২১ হাজার ৬১৪ পরীক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয়ে ৬৫ হাজার ৮৫ উত্তরপত্র চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করে। তাদের মধ্যে ৮১ জনের ফল পরিবর্তন হয়। এর মধ্যে ২১ জন নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে। ২৪ জন ফেল থেকে পাস করেছেন।
ময়মনসিংহ শিক্ষাবোর্ডে ১৮ হাজার ৬৯৯ পরীক্ষার্থী খাতা চ্যালেঞ্জ করে ৪৬ হাজার ২৪১টি। এরমধ্যে মোট ৮৯ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৭ শিক্ষার্থী। ফেল থেকে পাস করেছে ২৩ শিক্ষার্থী।
সিলেট শিক্ষাবোর্ডে মোট ৬ হাজার ৩০৬ পরীক্ষার্থী ১০ হাজার ৬৯টি খাতা চ্যালেঞ্জ করে। এরমধ্যে ৩৪ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। তাদের মধ্যে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫ জন। ফেল থেকে পাস করেছে ১৫ জন।
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে আলিম পরীক্ষায় মোট ২ হাজার ৭১৪ পরীক্ষার্থী ৭ হাজার ৮১৪টি খাতা চ্যালেঞ্জ করেন। তাদের মধ্যে মোট ৩৬ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। ফেল থেকে পাস করেছে ১০ জন শিক্ষার্থী, আর নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬ জন পরীক্ষার্থী।