নিজস্ব প্রতিবেদক:
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত কিশোরী ফেলানী হত্যাকাণ্ডের ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও সুরাহা হয়নি বিচারের।
ফেলানী হত্যা মামলার আইনজীবী ও পরিবারের অভিযোগ, আত্মস্বীকৃত খুনি ও বিএসএসফ সদস্য অমিয় ঘোষকে দুবার বেকসুর খালাস দিয়েছে ভারতের আদালত। সেই রায়ের বিরুদ্ধে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে রিট করেন ফেলানীর বাবা। আদালত রিটটি গ্রহণ করে শুনানি দিনও ধার্য করেন। কিন্তু শুনানি কয়েক দফা পিছিয়ে গত তিন বছরেও কার্যতালিকায় নেয়নি সুপ্রিম কোর্ট।
ফেলানীর পরিবার বলছে, তারা ন্যায়বিচারের সঙ্গে ক্ষতিপূরণও চান।
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের কলোনীটারি গ্রামের নুরুল ইসলামের মেয়ে ফেলানী। বাবার হাত ধরে ভারতের বঙ্গাইগাঁও গ্রাম থেকে বাংলাদেশে কলোনীটারির বাড়িতে আসার পথে ৭ জানুয়ারি ভোরে ফুলবাড়ীর অনন্তপুর সীমান্তে ভারতের ১৮১ ব্যাটালিয়নের চৌধুরীহাট ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারায় কিশোরী ফেলানী।
প্রায় চার ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে থাকে ফেলানীর নিথর দেহ। সেই ছবি দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নজর কারে।
দেশি-বিদেশী গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর চাপে ঘটনার আড়াই বছর পর ২০১৩ সালের ১৩ আগষ্ট ভারতের কোচবিহারে বিএসএফর সদর দপ্তরে স্থাপিত বিশেষ আদালতে ফেলানী হত্যা মামলার বিচার কাজ শুরু হয়। ফেলানীর বাবা ও মামার স্বাক্ষ্য শেষে ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে খালাস দেয় কোর্ট।
এ রায় নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। রায় প্রত্যাক্ষান করে ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম পুনরায় বিচার চেয়ে ভারতীয় হাই কমিশনারের কাছে করা আবেদন ১৩ সেপ্টেম্বর রিভিশন ট্রায়াল ঘোষণা করে। পুনরায় বিচারিক কার্য শেষে ২০১৫ সালের ২ জুলাই বিএসএফের আধিকারী সিপি ত্রিবেদীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বিচারিক প্যানেলের রায়ে আবারও খালাস পায় অমিয় ঘোষ।
সে রায়ের বিরুদ্ধে ফেলানীর বাবা ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) মাধ্যমে বিচার ও ক্ষতিপূরণ চেয়ে দেশটির সুপ্রিম কোর্টে রিট আবেদন করেন। কিন্তু ওই বছরের ১৩ জুলাই রিট গ্রহণ করলেও শুনানি দুইবার পিছিয়ে যায়। ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি পর আর কোনো কার্যাদেশ নেওয়া হয়নি।
বৃহস্পতিবার ফেলানীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের সদস্যরা ফেলানীর কবর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করছেন। পরিবারের পক্ষ থেকে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
মেয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম নুরু বলেন, ‘আর তো কাঁদতে পারি না। চোখে পানি নেই। ১১ বছর থেকে অপেক্ষা করছি। আর কত?’
তিনি বলেন, ‘ফেলানী হত্যার পর যেভাবে দেশ ও বিশ্বের মানুষ এগিয়ে এসেছে। আবারও সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বিচারের জন্য রাস্তায় নামতে হবে। তবে হয়তো আমি বিচার পাব।’
ফেলানীর মা জাহানারা বেগম বলেন, ‘মেয়ে হারাইছি। এখন পরিবার নিয়ে বাঁচতে পারছিনা। ছেলেমেয়ে বড় হইছে। পড়তেছে। অনেক খরচ। আমাদের দিকে সরকার যেন নজর দেয়। আমরা ক্ষতিপূরণ চাই। বিচারটা হোক দ্রুত এটাই চাই।’
রামখানা ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন বলেন, ‘ফেলানী হত্যার ন্যায়বিচার হলে সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফের নির্যাতন ও হত্যা কিছুটা হলেও কমত। শুরুতে বিচারের কার্যক্রমে আমরা আশা দেখছিলাম। কিন্তু দুইবারের পক্ষপাতের রায় আমাদের বিস্ময় হয়েছি। এরপর সুপ্রিম কোর্ট রিটটি ঝুলে রেখেছে।’
এদিকে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, দুদেশের সীমান্ত আইন আছে। কেউ সেই আইনের ব্যতয় ঘটালে আইন মোতাবেক বিচার হওয়া উচিৎ। গুলি করে মানুষ হত্যা বা নির্যাতন আইনের পরিপন্থি। দুই দেশের সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। সেটি হতে পারে ফেলানী হত্যার বিচারের সুষ্ঠু রায়ের মধ্য দিয়ে।
দীর্ঘ সময়ের ফেলানী হত্যা মামলার সহায়তা করেছেন কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট এস এম আব্রাহাম লিংকন।
তিনি বলেন, ‘আইনে আছে কোন মামলার রায়ে সন্তুষ্ট না হলে বাদীপক্ষ উচ্চ আদালতে যেতে পারে। আইনি প্রক্রিয়ায় সে কাজটি করেছে ফেলানীর বাবা। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রিটটি আমলে নিয়েছে। শুনানির দিন ধার্য করেছে। পরে পিছিয়েছে। এরপর যদিও বিশ্বব্যাপী করোনার একটা প্রভাব ছিল। তার জন্য বিলম্ব হতে পারে। তবে তিন বছর থেকে শুনানির তালিকায় না থাকা দুঃখজনক। এরপরও ন্যায়বিচার আশা করছি আমরা।’
বিএসডি/ এলএল