তিনি নেতা ছিলেন না, ছিলেন জনতার ভাই, বন্ধু, খোকা। সর্বোপরি তিনি ছিলেন নিপীড়িত, শোষিত আর অবহেলিত মানুষের মুক্তির দূত। তিনি হয়ে উঠেছিলেন সবার প্রিয় বঙ্গবন্ধু। ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতার একজন মানুষ যেন হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের পথপদর্শক। ভোরের আলো যেমন অন্ধকার দূর করে শুভ্র একটি মিষ্টি সকালের আবির্ভাব ঘটায় তেমনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৪ বছরের শাসন-শোষণের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠেছিলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মার্চ , ১৯৭১ঃ দীর্ঘ সংগ্রামের পর স্বাধীনতার উত্তাল মাস। বলা যেতে একইসাথে আমাদের জন্য গর্ব , হারানো ও বেদনার একটি মাস। ওই বছরের ১ মার্চ হঠাৎ এক হটকারী সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার আপামর জনতা। সেদিনই অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। পরবর্তীতে ২৫ মার্চ পর্যন্ত নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে এ অঞ্চলের স্বাধিকার আন্দোলন রূপ নেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে। যদিও ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর থেকে পূর্ব বাংলা চলে আসছিলো অনেকটা “de facto” রাষ্ট্রের মতো করে। কারণ ১৯৭০ এর নির্বাচনে এ অঞ্চলের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে একমাত্র ‘সিম্বোলিক ফিগারে’ পরিণত করেন। সময়ের পরিক্রমায় অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণটির আগমন ঘটে অর্থাৎ ৭ই মার্চ নামক ঐতিহাসিক দিনটির। ৭ই মার্চ সকাল থেকেই ঢাকায় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ছিল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ভীড়। তরুণ ছাত্রনেতারা তাঁকে স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করছিলেন। কিন্তু তিনি তো সর্বজ্ঞ, কখন কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাঁর চেয়ে ভালো আর কে জানে। শরীরে হালকা জ্বর নিয়ে সেদিন সকালটা বেশ ব্যস্ত সময় পার করেন তিনি। দুপুরে খাওয়ার পর বিশ্রামের জন্য রুমে গেলে কথা হয় তাঁর প্রিয় রেণুর সাথে। শেখ মুজিব গুরুত্বপূর্ণ কোন সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে সবসময় তাঁর সহধর্মিণীর সাথে আলাপ করতেন। সেদিন ভাষণ দিতে যাবার আগে তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন “তোমার সামনে জনগণ পিছনে গুলি, তোমার হৃদয় যা চাইবে তাই বলবে আজ।”
সেই রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রিয় মুজিব এলেন শুভ্র সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা এবং হাতকাটা কালো কোট পড়ে। মঞ্চে পূর্ব থেকেই গণসংগীত চলছিল। সেদিন মঞ্চে কবি একাই ভাষণ দিয়েছিলেন। তাঁর আগমনের শুরুতে যেমন গগনবিধারী চিৎকার ছিল তেমনি ভাষণ শুরু হতেই নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সব দিকনির্দেশনা নিহিত ছিল এই একটিমাত্র ভাষণে যাও কিনা সম্পূর্ণ অলিখিত। সেদিন ভাষণ শেষে জনতা যেন ধর্মীয় কোনো সভা থেকে প্রফুল্ল চিত্তে ফিরে গিয়েছিলো। ভাষণের শুরুতে বলছিলেন ‘ভায়েরা আমার’ , একটু পর আবার বলেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে’, ‘১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে’, ‘আমার গরীবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের উপরে গুলি করা হয়েছে’, ‘যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে’, ‘আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়’, ‘তোমরা আমার ভাই’। নেতা তো তিনিই যিনি তাঁর দেশের আপামর জনতাকে নিজ ভাইয়ের মতো আপন করে নিতে জানেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর দেশের প্রত্যেক মানুষকে এই ভাষণে ‘আমার ভায়েরা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। কতোটা দরদী হলে এভাবে বলা যায়। তাঁর ভাষণের এসব দিক বিশ্লেষণ করলে এদেশের মানুষের প্রতি চিরায়ত মায়া ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ফুটে উঠে। তিনি ছিলেন আজীবন বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীঃ ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি একবারের জন্যও পূর্ব পাকিস্তান কথাটি উল্লেখ করেননি।কারণ তিনি সবসময় বিশ্বাস করে এসেছেন বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৯ এও বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের কথাই বলা আছে। ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি অসংখ্যবার বাংলা শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। আমরা দেখতে পাই তিনি বলছিলেনঃ
বাংলার মানুষ মুক্তি চাই, বাংলার মানুষ বাঁচতে চাই, বাংলার মানুষ তার অধিকার চাই নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস দোষ দেয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেয়া হলো আমাকে আমার বাংলার মানুষের উপর গুলি করা হয়েছে সমস্ত দোষ বাংলার মানুষের উপর দিয়েছেন এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান, বাঙ্গালি অবাঙ্গালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে বঙ্গবন্ধু মুক্তিতে বিশ্বাস করতেন। ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি মোট পাঁচ জায়গায় মুক্তির কথা বলেছেন। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায় এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
মূলত মুক্তি কথাটি দিয়ে পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসন শোষণের হাত থেকে মুক্তি চেয়েছেন। তিনি বারবার বলতেন ‘আমি শোষিতের পক্ষে’। প্রকৃতপক্ষে তিনি সমাজতন্ত্রের পূজারী ছিলেন। তাঁর ভাষণে শুনতে পাই ‘আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা পয়সা পৌঁছিয়ে দিবেন। আর এই সাতদিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছায়ে দেবেন। বিশ্ব যখন শাসক আর শোষিত এই দুই ভাগে বিভক্ত তখন তিনি শোষিতের মুক্তির দূত হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১০ এ সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি তাঁর এই কথারই বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু গণতন্ত্রের জয়গান গেয়েছেনঃ তিনি বলছিলেন “যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলী বসবে। আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এই দেশকে আমরা গড়ে তুলবো। আপনারা আসুন বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি’। আমরা জানি সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথাই বলা হচ্ছে। তিনি এই ভাষণে অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্ফূরণ ঘটিয়েছেনঃ এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান, বাঙ্গালি অবাঙ্গালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপর। আমাদের যেন বদনাম না হয়। সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদে উল্লেখিত ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা যেন তাঁর এই কথারই সাক্ষ্য বহন করছে। নেতাকে হতে হবে মানবিক যিনি সবসময় জনগণের কথা মনে রাখবেনঃ তিনি বঙ্গবন্ধু, আপামর জনগণের নেতা। জনতার কথা স্মরণে রেখেই তিনি এদিন বলেছিলেন “গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সেজন্য সমস্ত রিকশা, গরুর গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। দুই ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে যাতে মানুষ তাদের মায়নাপত্র নিবার পারে”। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দখলদার হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র বাঙ্গালি সম্মুখ সমরে মিলিত হলে আমাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে, এজন্য তিনি তাঁর ভাষণে দিয়ে গেছেন গেরিলা যুদ্ধের নির্দেশনা। বঙ্গবন্ধু বলেন “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা কিছু আছে, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।” তিনি জানতেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে। তাই তিনি বলেছিলেন “আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো।” বস্তুত যুদ্ধ যদি বর্ষাকালে গড়ায় তবে এই অঞ্চলে মাঠ-ঘাট ডুবে যাবে। ফসলের উৎপাদন কমবে এবং পাকিস্তানিরা সাঁতারে ততটা পটু নয়।তাই তিনি তখন তাদের ভাতের অভাবে ও পানিতে চুবিয়ে মারার কথা বলেছেন।
যারা রাজনীতি করেন, যারা জনগণের আস্থাশীল তাঁরা বেশ আগে থেকেই ধারণা করতে পারেন ভবিষ্যতে কি ঘটতে চলেছে। ভাষণটির এক জায়গায় তাঁকে বলতে শোনা যায় “হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার উপর দিয়েছেন, বাংলার মানুষের উপর দিয়েছেন।” তিনি যে সর্বজ্ঞ এখানেই সেটির আভাস দিয়েছিলেন। মূলত এর মাধ্যমে তিনি ‘লারকানা ষড়যন্ত্রের’ দিকে দৃষ্টি রেখেছেন। একটু পিছনে যাওয়া যাক। ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জেড. এ. ভুট্টোর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদ, প্রধান স্টাফ অফিসার লে. জে. পীরজাদাসহ আরো কিছু সামরিক কর্মকর্তা ভুট্টোর ‘লারকানা হাউসে’ জড়ো হন। বস্তুত এখানেই ‘পাখি শিকার’ করার অন্তরালে গণহত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল যা খাদিম হুসেন রাজার “A stranger in my own country” বই থেকেও অল্পবিস্তর জানা যায়। রবার্ট পেইন তাঁর Massacre: The tragedy at Bangladesh and the phenomenon of mass slaughter throughout history বইতে লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে একটা সর্বাত্মক গণহত্যা শুরুর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে যায় ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন সেনা সদর দপ্তরে বৈঠকে বসেছিলেন পাঁচ শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা। এই পাঁচজন হলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, চিফ অব স্টাফ জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল টিক্কা খান, জাতীয় নিরাপত্তা কমিশনের চেয়ারম্যান জেনারেল উমর খান এবং গোয়েন্দা শাখার প্রধান জেনারেল আকবর খান। সেখানেই তাঁরা গণহত্যার একটি নীলনকশা তৈরি করেন। কিভাবে যুদ্ধ হবে বা কারাই বা দিকনির্দেশনা দেবেন তাও তিনি বলেছেন তাঁর ভাষণে, “প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু কেন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন নাঃ সিদ্দিক সালিক তার “witness to Surrender” বইতে তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন- ১. সম্ভবত ৬ই মার্চ ইয়াহিয়ার সাথে শেখ মুজিবের ফোনে কথা হয় যাতে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে ভাষণে শান্তির বার্তা দিতে অনুরোধ করেন ২. পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড এক পক্ষীয় স্বাধীনতা ঘোষণা না দিতে বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ জানান ৩. জিওসি খাদিম হুসেন রাজার নিরস্ত্র বাঙ্গালিদের উপর হামলে পড়ার কড়া বার্তা
যদি বঙ্গবন্ধু সেদিন স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন তবে সেটি হতো ‘Unilateral Declaration of Independence বা UDI’ তখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী ঘোষণা দিয়ে সাথে সাথে বাংলাদেশে আক্রমণ করতে পারতো। কারণ আকাশে তখন পাকিস্তানী জঙ্গী বিমান হামলার উদ্দেশ্যে উড়ে বেড়াচ্ছিল। তিনি চাইছিলেন সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের উপর আক্রমণ হলে তিনি বিশ্ববাসীকে দেখাতে পারবেন দখলদার হানাদার বাহিনীর বর্বরতা। তিনি এমনভাবে স্বাধীনতার কথা বললেন যাতে অপূর্ণতা বলতে কিছুই রইলো না। তাঁর বক্তব্যে বিভ্রান্ত হয়ে ISI রিপোর্ট করে “ চতুর শেখ মুজিব চতুরতার সাথে বক্তৃতা করে গেলেন, এক দিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলেন অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হবার দায়িত্ব নিলেন না। আমাদের বসে বসে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না।” লিখার শুরুতে বলছিলাম বাংলাদেশ তখন চলছিলো অনেকটা ‘de facto’ রাষ্ট্রের মতো করে। ডি ফ্যাক্টো শব্দটি ল্যাটিন যার অর্থ হলো কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্র। কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্রে মৌলিক চারটি উপাদান (ভূমি, সরকার, জনসংখ্যা ও সার্বভৌমত্ব) বহাল থাকে। তবে তার পঞ্চম এবং গৌণ উপাদানটি (স্বীকৃতি) সীমিত থাকে বা থাকে না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে পূর্ব বাংলার সবকিছু চলছিলো যা তাঁর দেয়া ৭ই মার্চের ভাষণে সাধারণ মানুষের প্রতি দিকনির্দেশনা, সরকারী কর্মচারীদের প্রতি তাঁর নির্দেশ, শিল্পকলকারখানা মালিকদের প্রতি শ্রমিকদের বেতন পৌঁছে দেবার নির্দেশ থেকে প্রতীয়মান হয়। আরেক প্রকার রাষ্ট্র হলো ‘de jure’ রাষ্ট্র। ডি জুরি মানে হল আইনত স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। অর্থাৎ রাষ্ট্র গঠনের চারটি মৌলিক উপাদান (ভূমি, সরকার, জনসংখ্যা ও সার্বভৌমত্ব) ছাড়াও এর বাড়তি আরো একটি যোগ্যতা আছে। সেটি হলো স্বীকৃতি।অন্যান্য আইনত স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। সেসময় এই স্বীকৃতিই শুধুমাত্র বাংলাদেশের ছিল না। ভাষণটির এক জায়গায় তাঁকে বলতে শোনা যায় “রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।” পবিত্র কোরআনের সুরাঃ কাহফ, আয়াতঃ ২৩-২৪ এ ইনশাল্লাহ শব্দের ব্যাখ্যা দেয়া আছে। এতে বলা হচ্ছে ভবিষ্যতে কোন কাজ মহান রবকে স্মরণ করে করার উদ্দেশ্যেই বান্দা মূলত ‘ইনশাল্লাহ ’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। আর ইনশাল্লাহ শব্দটি একবার উচ্চারণ করে ফেললে কাজটি তিনি করবেন এই অঙ্গীকারই ব্যক্ত করা হয়। বাংলাকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে রূপান্তরিত করে তিনি সে কথা রেখেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে বেশ কয়েকটি ভাষণের সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে তার মধ্যে একটি হলো আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের বিখ্যাত গেটিসবার্গ ভাষণ “Government of the people, by the people, for the people, Shall not perish form the earth.” কালো মানুষের অধিকার আদায়ে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ ও মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং এর “I have a dream”, অন্যদিকে মহাত্মা গান্ধীর Quit India- “Ours is not a drive for power but purely a non violent fight for India’s independence”, ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পেলোপোনেশিয়ান যুদ্ধের প্রথম বছরে পেরিক্লিসের দেয়া “Pericles’s Funeral Oration”, এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষের অধিকার আদায়ের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার “I am prepared to die” প্রভৃতি কালজয়ী ভাষণের সাথে যা কিনা সারা পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা বঞ্চিত, নিপীড়িত, শোষিত ও মুক্তিকামী মানুষকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে নিরন্তর। আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিং, চার্চিল বা গান্ধীর মতো মহান নেতাদের ভাষণের মতো শেখ মুজিবের ভাষণ দেবার প্রেক্ষাপটও ছিল ভিন্ন তবে বঙ্গবন্ধুর মতো পরাধীন দেশে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন কেবল মহাত্মা গান্ধী। ২০১৩ সালে প্রকাশিত Jacob Franz Field তাঁর গ্রন্থে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের দেয়া ভাষণ থেকে শুরু করে এই নিকট অতীতে দেয়া ভাষণকে স্থান দিয়েছেন যেখানে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নেতা,রাষ্ট্রনায়ক ও মিলিটারি জেনারেলদের উদ্দীপনামূলক বক্তব্য রয়েছে যাতে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়েছে। তার দৃষ্টিতে সেরা ৪০টি ভাষণ এতে সংকলিত হয়েছে। গ্রন্থটির শিরোনাম দেয়া হয়েছে “We Shall Fight on the Beaches: The Speeches that Inspired History”। এই শিরোনামটি নেয়া হয়েছে উইনস্টন চার্চিলের ১৯৪০ সালের ৪ জুন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দেয়া ভাষণ থেকে। ১৬৭ পাতার এই বইয়ের অর্ধেকটা জুড়ে আছে উইনস্টন চার্চিল-এর বিখ্যাত ভাষণ, বাকিটায় স্থান পেয়েছে অন্যান্য শ্রেষ্ঠ ভাষণ। আমাদের সংবিধানের চারটি মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা যদিও বঙ্গবন্ধু তাঁর ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালে সরাসরি বলেছেন কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় এই চারটি মূলনীতির কথা তিনি ৭ই মার্চের ভাষণেও বলে গেছেন যা পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি সম্প্রতি ইউনেস্কোর “Memory of the World Resister” এ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্রের ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এর পূর্বে বর্তমান সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টা ও কানাডায় বসবাসরত দুইজন প্রবাসী বাঙ্গালি রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম (তাঁরা ছিলেন মাতৃভাষা প্রেমিকগোষ্ঠীর সদস্য) -এর উদ্যোগে ২১ ফেব্রুয়ারিও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা পায়। ইউনেস্কোর ৩০তম অধিবেশনে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আরেকটি গৌরবের বিষয় হলো ইউনেস্কোর তৎকালীন মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর প্যারিসে অবস্থিত সদর দপ্তরে জানান ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষণকে “World’s Documentary Heritage” (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রত্যেকটি বাঙ্গালি জাতির জীবনে ৭ই মার্চ একটি অবিস্মরণীয় দিন। বাঙ্গালির বীরোচিত সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই দিকনির্দেশনায় ছিল বজ্রকঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। কালজয়ী ও অবিস্মরণীয় এ ভাষণ বিশ্বের নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত ও মুক্তিকামী মানুষকে সবসময় বিজয়ের পথে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাবে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ এবং ত্রিশ লক্ষ শহিদ ও দুই লক্ষ মা বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের মাধ্যমে এই লাল সবুজের দেশটি লাভ করি। কোনো জাতিকে তার আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। চাইলেই বন্দুকের নল কিংবা অস্ত্রের মুখে দাবায়ে রাখা যায় না। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুর সাত কোটি বাঙ্গালিকে দাবায় রাখতে পারেনি। একটি ভাষণ কীভাবে গোটা জাতিকে জাগিয়ে তোলে, স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করে, সর্বোপরি একটি জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটায় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ তারই একটি বাস্তব উদাহরণ। ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ছয় দফা পেশ করার মাধ্যমে বাঙ্গালিকে যে স্বাধিকারের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সেটিই ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে স্বাধীনতার স্বপ্নে পরিণত হয় এবং দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। ভাষণ বলতে সাধারণত কোন বিষয়ে শ্রোতাকে উদ্দেশ্য করে বলাকে বুঝায় আর অভিভাষণ বলতে শ্রোতার উদ্দেশ্যে যখন সর্ব্বোচ্চ উৎকর্ষ সহকারে, মুখের ভাষার সাথে শারীরিক অঙ্গভঙ্গির এক অদ্ভুত মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে বিষয়টিকে শ্রোতার নিকট আরো বেশি গ্রহণযোগ্য করে তোলা হয়। সেই অর্থে বলা যেতে পারে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে একটি অভিভাষণ।
লেখকঃ শিবু দাশ সুমিত
সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট,
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, নড়াইল