খেলাধূলা প্রতিদিন:
সোমবার সাগরিকায় বাংলাদেশ দলের ছিল অনেক কিছু পাওয়ার দিন। সফরকারী আফগানিস্তানকে শুধু প্রথমবার হোয়াইটওয়াশ করাই নয়, আইসিসি ওয়ানডে বিশ^কাপ সুপার লীগে আরও ১০ পয়েন্ট অর্জন এবং র্যাঙ্কিংয়ে পাকিস্তানকে হটিয়ে ছয়ে ওঠার মোক্ষম সুযোগ। টানা ২ জয়ে দারুণ আত্মবিশ^াসী হয়ে নামে বাংলাদেশ। কিন্তু উল্টো ৭ উইকেটের বিশাল জয়ে বাংলাদেশের কাছ থেকে ১০ পয়েন্ট কেড়ে নিয়েছে আফগানরা। এ ম্যাচে তাই বাংলাদেশের প্রত্যাশিত কিছুই বাস্তবে পরিণত হয়নি। ২-১ ব্যবধানে সিরিজ অবশ্য জিতেছে। কিন্তু এ ম্যাচ জিতেই সুপার লীগে দুই ধাপ উন্নতি হয়েছে আফগানদের। ৯ ম্যাচে ৭ জয়ে ৭০ পয়েন্ট নিয়ে এখন ৪ নম্বরে তারা। ১৫ ম্যাচে ১০ জয়ে ১০০ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশই যথারীতি শীর্ষে। আফগানদের সঙ্গে ব্যবধান শুধু ৯৫ পয়েন্টে দুইয়ে থাকা ইংল্যান্ড ও ৭৯ পয়েন্ট নিয়ে তিনে থাকা ভারত! হোয়াইটওয়াশ এড়ানোর লড়াইয়ে ব্যাটিং-বোলিংয়ে অনেক ঘাটতি পুষিয়ে ওঠার লড়াই ছিল আফগানদের। তাদের দুর্দান্ত বোলিংয়ে ব্যাটিং বিপর্যয় ঘটা বাংলাদেশ ১৯২ রানেই গুটিয়ে যায় ৪৬.৫ ওভারে। আর রহমানুল্লাহ গুরবাজের অপরাজিত শতকে ৫৯ বল হাতে রেখেই ৩ উইকেট হারিয়ে ১৯৩ রান তুলে সহজ জয় ছিনিয়ে নেয় আফগানিস্তান।
সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচে ব্যাটে-বলে স্বাগতিক বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল। আর তাই জয় ছিনিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ। টানা দুই জয়ে ২০ পয়েন্ট নিয়ে সুপার লীগের শীর্ষে ওঠে তামিম ইকবালের দল। কিন্তু প্রত্যাশা বেড়ে যায় সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডেতে। ২ দিন সময় পেয়ে অবশ্য ব্যাটিং-বোলিংয়ে নিজেদের করা ভুলগুলো বিশ্লেষণ করে কঠোর অনুশীলনে তা কাটিয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে আফগানরা। সফরকারী দল হিসেবে স্বাগতিকদের বিপক্ষে একটি জয় তাদের চাই-ই চাই। কিন্তু ১ ম্যাচ হাতে রেখে সিরিজ জয়ে ফুরফুরে মেজাজে থাকা বাংলাদেশ দল বেশ আত্মবিশ^াসীই ছিল এবং ২ দিন ঐচ্ছিক অনুশীলনে অনেকেই বিশ্রাম নিয়েছেন হোটেল কক্ষে। সেটার ছাপ হয়তো সোমবার সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে পড়েছে। টস জিতে এবারও ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন অধিনায়ক তামিম। রানে ফিরতে মরিয়া অভিজ্ঞ এ বাঁহাতি ওপেনার অবশ্য ২ দিন ব্যাটিং কোচ জেমি সিডন্সকে নিয়ে অনেক পরিশ্রম করেছেন সাগরিকার নেটে। কিন্তু লোকাল বয় তামিম এদিন সতর্ক শুরুর পরও দলীয় ৪৩ রানের সময় ২৫ বল খেলে মাত্র ১১ রানেই সাজঘরে ফেরেন। আগের দুই ম্যাচে তাকে এলবিডব্লিউ করেছিলেন বাঁহাতি পেসার ফজল হক ফারুকী। এবার তিনি তাকে বোল্ড করে দেন। দ্বিতীয় উইকেটে সাকিব আল হাসানের সঙ্গে দারুণ জুটি গড়ে ওঠে লিটন দাসের। এদিনও দুর্দান্ত খেলছিলেন ফর্মে থাকা এ ডানহাতি ব্যাটার। ৩০তম বাংলাদেশী হিসেবে ক্যারিয়ারের ৫০তম ওয়ানডেতে নেমে দেখেশুনে খেলে মাত্র ৬৩ বলেই ক্যারিয়ারের চতুর্থ ফিফটিতে পৌঁছেন ৫ চারে। ২১তম ওভারেই দলীয় শতরানে পৌঁছে বাংলাদেশ। কিন্তু সাকিবের সঙ্গে তার ৬৩ রানের দুর্দান্ত জুটিতে ভাঙ্গন ধরান আজমতুল্লাহ ওমরজাই।
বেশ সাবলীল থাকা সাকিব ৩৬ বলে ৩ চারে ৩০ রানে বোল্ড হয়ে যান। এরপর দ্রুতই মুশফিকুর রহিম (৭) ও ইয়াসির রাব্বির (১) বিদায় দেখেছেন লিটন। তিনি তাই গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। তবে এগোতে থাকেন আরেকটি সেঞ্চুরির দিকে। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের সঙ্গে পঞ্চম উইকেটে আরও ২৮ রান যোগ করেন। এরপর নিজেই সাজঘরে ফেরেন মোহাম্মদ নবির অফস্পিনে লংঅনে গুলবাদিন নাইবকে ক্যাচ দিয়ে। ১১৩ বলে ৭ চারে করা ৮৬ রানের ইনিংসটি শেষ হয়। দেশের তৃতীয় ব্যাটার হিসেবে ৫০ ম্যাচেই ১৫ হাজার রান পেরিয়ে যান তিনি। লিটনের বিদায়ের পর এলোমেলো হয়ে যায় বাংলাদেশের ব্যাটিং। আফগান বোলাররাও সুযোগ পেয়ে দুর্দান্ত বোলিং করেন। আর তাতে চাপ বেড়েছে। তাই ২১.৩ ওভারে ১ উইকেটে ১০৪ রান তোলা বাংলাদেশ পরের ৮৮ রান তুলতেই ব্যাটিং ব্যর্থতায় হারিয়েছে বাকি ৯ উইকেট। এর মধ্যে শেষ ৪টি উইকেটের পতন হয়েছে মাত্র ১৭ রানে। অবিবেচকের মতো রান আউট হয়েছেন মেহেদি হাসান মিরাজ, শরিফুল ইসলাম ও মুস্তাফিজুর রহমান। তাই আফগানদের বিপক্ষে নিজেদের দ্বিতীয় সর্বনি¤œ ১৯২ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশের ইনিংস। লিটন যেখানে একাই ৮৬ রান করেছেন, সেখানে বাকি ১০ জনে করতে পেরেছেন মাত্র ১০৬ রান। সেই ১০৬ রানের মধ্যে সাকিব-মাহমুদুল্লাহর রান বিয়োগ করলে ৮ জনের রান দাঁড়ায় মাত্র ৪৭! মাহমুদুল্লাহ শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন ৫৩ বলে কোন বাউন্ডারি ছাড়া ২৯ রানে। ১৯ বল আগেই গুটিয়ে গেছে বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচে ১৭৭, দ্বিতীয় ম্যাচে ১৪৬ এবং এ ম্যাচে ১৯০টি বলে কোন রান নিতে পারেননি বাংলাদেশী ব্যাটাররা। এসব থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় কতটা বাজে ব্যাটিং পারফর্মেন্স ছিল এদিন। আগের দুই ম্যাচে নিষ্প্রভ লেগস্পিনার রশিদ খান ও অফস্পিনার নবি এদিন জ¦লে উঠেন। রশিদ ১০ ওভারে ৩৭ রানে ৩ ও নবি ১০ ওভারে ২৯ রানে ২ উইকেট নিয়েছেন।
প্রতিপক্ষকে মাত্র ১৯২ রানে বেঁধে ফেলেই আত্মবিশ^াসী হয়ে ব্যাটিং শুরু করে দুই আফগান ওপেনার গুরবাজ ও রিয়াজ হাসান। আক্রমণাত্মক গুরবাজের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে উড়ন্ত সূচনা পায় তারা। মাত্র ৫৩ বলে ফিফটি পেয়ে যান আগের দুই ম্যাচে ৭ রানেই আউট হওয়া এ ২০ বছর বয়সী তরুণ। ৭৯ রানের উদ্বোধনী জুটিতে চিড় ধরান সাকিব, স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলে ফেরান ৪৯ বলে ৪ চার, ১ ছক্কায় ৩৫ রান করা রিয়াজকে। কিন্তু এরপর রহমত শাহ নেমে শক্ত ভিতে দাঁড়িয়ে ভারমুক্ত হয়ে অবলীলায়, নিঃসঙ্কোচে ব্যাট চালিয়েছেন। যদিও ব্যক্তিগত ৬০ রানে মুশফিককে এবং ৬১ রানে ফাইন লেগে মাহমুদুল্লাহকে সহজ ক্যাচ দিয়েছিলেন গুরবাজ। দুবারই বাঁহাতি পেসার শরিফুল উইকেট প্রাপ্তির আনন্দে ভাসতে পারেননি। এরপর আর সুযোগ দেননি গুরবাজ। কিন্তু ৬৭ বলে ৩ চারে করা রহমতকে ফিরিয়ে ১০০ রানের দ্বিতীয় উইকেট জুটি ভেঙ্গেছেন মিরাজ। পরের ওভারেই অধিনায়ক হাশমতুল্লাহ শহিদীকে (২) এলবিডব্লিউ করে দেন তিনি। কিন্তু তখন জয়ের অনেক কাছে আফগানরা। বাংলাদেশের মুঠো থেকে বেরিয়ে গেছে ম্যাচের ফল। নবম ম্যাচে নেমে ক্যারিয়ারের তৃতীয় এবং বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম আফগান হিসেবে সেঞ্চুরি হাঁকান মাত্র ১০৩ বলে। তিনি ১১০ বলে ৭ চার, ৪ ছক্কায় ১০৬ রান করে দলকে জয় এনে দিয়েছেন ৫৯ বল থাকতেই। ৪০.১ ওভারে ৩ উইকেটে ১৯৩ রান তোলে আফগানিস্তান। ব্যাটিং-বোলিংয়ে গত দুই ম্যাচের ঘাটতিগুলো কাটিয়ে স্বাগতিক বাংলাদেশের পারফর্মেন্সকে ছাপিয়ে গেছে সফরকারীরা। তাই তারা সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডে জিতেছে ৭ উইকেটের বড় ব্যবধানে। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বড় হার থেকে শিক্ষা নিয়ে দারুণ উন্নতি করেছে আফগানরা। সেই ম্যাচে অগোছালো বোলিংয়ে ১৮ ওয়াইড দিয়েছে তারা। এবার তারা দিয়েছে মাত্র ৭ ওয়াইড। নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের পর মামুলী লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে হিসেবী ছিল আফগানরা।
৩ ম্যাচের সিরিজে টানা দুই ম্যাচ জিতেও প্রতিপক্ষকে এ নিয়ে তৃতীয়বার হোয়াইটওয়াশ করতে ব্যর্থ হলো বাংলাদেশ। দেশের মাটিতে ২০১৫ সালে ভারত ও গত বছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হয়নি। এবার আফগানদের বিপক্ষেও হলো না। দুদলের মধ্যে লড়াইয়ে এটাই পরে ব্যাট করে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়। এর আগে দুইবার দুদলের লড়াইয়ে পরে ব্যাট করা দল জিতেছে। প্রথমবার আফগানরা ২০১৬ সালে মিরপুরে মাত্র ২ উইকেটে এবং দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ চলতি সিরিজেরই প্রথম ওয়ানডেতে ৪ উইকেটে জয় পায়। ২০১৬ সালে হওয়া দুদলের একমাত্র দ্বিপাক্ষিক ওয়ানডে সিরিজও ২-১ ব্যবধানে জিতেছিল বাংলাদেশ। এবারও একই ফল, তবে ১০ সুপার লীগে ১০ পয়েন্ট হারানোর আক্ষেপ নিয়ে অধিনায়ক তামিম বললেন, ‘খুবই হতাশাজনক। ওয়ানডে চ্যাম্পিয়নশিপে একই অবস্থানে ছিলাম আমরা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এবং আমরা ভালভাবে শেষ করতে পারিনি। আবারও তাই ঘটল। এটাকে আমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ ভেবেছি সিরিজের। কারণ যতটা সম্ভব পয়েন্ট অর্জনের ব্যাপার ছিল।’
বিএসডি/ এফএস