নিজস্ব প্রতিবেদক,
উন্নত বিশ্ব পরিবেশ টিকাতে স্বাভাবিক হচ্ছে আমাদেরও নজর দিতে হবে টিকায়
দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি চলছে। মহামারিকালে সোমবার (২৮ জুন) দেশে সর্বোচ্চ আট হাজার ৩৬৪ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর আগের দিন রবিবার (২৭ জুন) রেকর্ড ১১৯ জনের মৃত্যু হয়। সোমবার মৃত্যু হয় ১০৪ জনের। অর্থাৎ দেশে টানা দুই দিন ধরে মৃত্যু একশ’র ওপরে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাধান শুধুমাত্র টিকাতেই উন্নত বিশ্ব পরিবেশ টিকাতে স্বাভাবিক হচ্ছে আমাদেরও নজর দিতে হবে টিকায়
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশের ৬৪টির মধ্যে ৪০টি জেলা ‘অতি উচ্চ’ ঝুঁকিতে আছে। ১৫টি জেলা রয়েছে উচ্চ ঝুঁকিতে, আটটি জেলা মধ্যম ঝুঁকিতে। বান্দরবান জেলায় নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কম হওয়ায় এই জেলাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। রিপোর্ট অনুযায়ী, খুলনা বিভাগের ১০টি জেলার সবক’টিই উচ্চ ঝুঁকিতে।
করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি টিকা এই ভাইরাস প্রতিরোধের অন্যতম উপায়। দেশে গত ২৭ জানুয়ারি জাতীয়ভাবে টিকা দেওয়া শুরু হয় অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত ও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি কোভিশিল্ড টিকার মাধ্যমে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত মোট এক কোটি এক লাখ সাত হাজার ১৪১ জন মানুষকে এ টিকা দেওয়া হয়েছে।
দেশে কোভিশিল্ড টিকার স্বল্পতা রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, এই টিকার সংকট খুব দ্রæত শেষ হবে না। তবে কোভিশিল্ড নিয়ে যখন সংকট, তখনই চীনের সঙ্গে চুক্তি এবং কোভ্যাক্স সুবিধার আওতায় ফাইজার এবং মডার্নার টিকা আসার খবরে কিছুটা যেন আশার আলো দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, অল্প দিনের মধ্যেই মডার্নার ২৫ লাখ টিকা আমরা পাচ্ছি। চীন থেকেও তাড়াতাড়ি টিকা পাবো। চুক্তি অনুযায়ী, জুলাই মাসেই চীনের টিকা পেতে শুরু করবো। কোভ্যাক্স থেকেও টিকা পেতে থাকবো। এই সময়ের মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গেও হয়তো আমাদের চুক্তি করার কাজ শেষ করতে পারবো। কাজেই টিকা কার্যক্রম আগামীতে বন্ধ রাখতে হবে না।।
েেকাভিশিল্ড দিয়ে শুরু, শেষটা সংকটে: টিকা কার্যক্রম নিয়ে শুরুটা অন্য অনেক দেশের চেয়ে ভালো হলেও বর্তমানে টিকা নিয়ে সংকটে ভুগছে বাংলাদেশ। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে তিন কোটি ডোজের চুক্তি করলেও এরমধ্যে মাত্র ৭০ লাখ পেয়েছে বাংলাদেশ। আর দেশে টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পর থেকে কোভিশিল্ড দেওয়া হয়েছে (২৮ জুন পর্যন্ত) এক কোটি এক লাখ সাত হাজার ১৪১ ডোজ।
প্রসঙ্গত, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত ও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি কোভিশিল্ডের তিন কোটি ডোজ টিকার চুক্তিতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে তিন কোটি ডোজ টিকা রফতানি করবে এবং সেই অনুযায়ী প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ পাওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ সেই প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী টিকা পায়নি। সেরাম থেকে কেবল জানুয়ারিতে ৫০ লাখ, আর ফেব্রæয়ারি এসেছে ২০ লাখ। সেই হিসাবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ চুক্তির তিন কোটি টিকা থেকে পেয়েছে মাত্র ৭০ লাখ ডোজ। তবে দেশে কোভিশিল্ডের এক কোটি দুই লাখ ডোজের মধ্যে বাকিটা ভারত সরকারের উপহার হিসেবে দেওয়া।
কোভিশিল্ড টিকার স্বল্পতা রয়েছে জানিয়ে অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘এই সংকট খুব দ্রæত শেষ হবে না।’
তিনি বলেন, ‘এর সমাধান চট করেই হয়ে যাচ্ছে বলে আমরা মনে করছি না। কারণ, ভারত থেকে এই টিকা যতটুকু পাওয়ার কথা ছিল তার সমাধান এখনও হয়নি। একইসঙ্গে অন্যান্য স্থান থেকেও এই টিকা পাওয়া সম্ভব না। কোভিশিল্ডের সংকট দেখা দেওয়ায় ২৬ এপ্রিল থেকে প্রথম ডোজ এবং ২ মে’র পর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় টিকার জন্য নিবন্ধনও।
চীনের চুক্তিতে আশা
গত ১৯ জুন থেকে চীন সরকারের উপহার সিনোফার্মের টিকা দিয়ে দেশে আবারও শুরু হয় টিকাদান কার্যক্রম। প্রাথমিকভাবে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের দিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত এই টিকা দেওয়া হয়েছে ৪৫৭ জনকে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে মোট ১১ লাখ ডোজ সিনোফার্মের টিকা উপহার দিয়েছে চীন। এরমধ্যে ৩০ হাজার ডোজ এ দেশে কর্মরত নিজেদের কর্মীদের জন্য নেয় চীন। বাকি ১০ লাখ ৭০ হাজার ডোজ টিকা দেশের ৫ লাখ ৩৫ হাজার মানুষকে দেওয়া যাবে।গত ১৩ জুন ছয় লাখ, আর এর আগে গত মে মাসেও সিনোফার্মের পাঁচ লাখ টিকা উপহার হিসেবে বাংলাদেশকে দিয়েছিল চীন।
উপহার ছাড়াও চীনের সিনোফার্মের সঙ্গে দেড় কোটি ডোজ টিকা ক্রয়ের চুক্তি চূড়ান্ত করা হয়েছে। গত ২৫ জুন চীনের সঙ্গে চুক্তির টিকা কবে নাগাদ আসবে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আশা করছি কিছু দিনের মধ্যে একটা লট টিকা আমাদের দেবে। তবে তারা কতটুকু দেবে সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত নই।’
ভরসায় কোভ্যাক্স-স্বাস্থ্য অধিদফতর গত ১১ জানুয়ারি জানিয়েছিল, কোভ্যাক্স থেকে ছয় কোটিরও বেশি টিকা আসবে মে থেকে জুন মাসের মধ্যে। কিন্তু সেসব টিকা আসেনি। তবে কোভ্যাক্স থেকে ফাইজারের কিছু টিকা এসেছে। একই সঙ্গে আরও আসবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
গত ২৫ জুন কোভ্যাক্স সুবিধার আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার ২৫ লাখ ডোজ টিকা পাওয়া যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘টিকা পেতে গত জুনে কোভ্যাক্সকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ। সেই হিসাবে পর্যায়ক্রমে প্রায় সাত কোটি টিকা দেওয়ার কথা আমাদের।
কোভ্যাক্স-এর পূর্ণাঙ্গ রূপ হলো কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস ফ্যাসিলিটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিøউএইচও) ছাড়াও উদ্যোগটির সঙ্গে রয়েছে কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশন এবং দাতব্য সংস্থা গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই)। এ উদ্যোগের লক্ষ্য হচ্ছে, ভ্যাকসিন মজুত করে না রেখে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সর্বোচ্চ ঝুঁকির দেশগুলোতে তা বণ্টন করার জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারকে উৎসাহিত করা।
গত ৩১ মে কোভ্যাক্সের আওতায় ফাইজার-বায়োএনটেকের এক লাখ ৬০২ ডোজ টিকা দেশে পৌঁছানোর পর গত ২১ জুন এ টিকা দেওয়া শুরু হয়। তবে তাদের সাত দিনের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
টিকা নিয়ে পুরো বিষয়ের কী অবস্থা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, এখনও কংক্রিট কোনও খবর নেই, তবে গুছিয়ে উঠেছি। আশা করছি, খুব শিগগিরই বেশ কিছু টিকা পাবো। বিভিন্ন টিকা নিয়ে কথা হচ্ছে আমাদের। কোন কোন টিকা পাওয়া যাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চীন থেকে কেনা সিনোফার্ম টিকা জুলাই নাগাদ চলে আসবে, কোভ্যাক্স থেকে পাওয়া যাবে জুলাই নাগাদ।
প্রসঙ্গত, ফাইজারের টিকা মাইনাস ৯০ ডিগ্রি থেকে মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হয় বলে এ টিকার সংরক্ষণ বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে এ ব্যবস্থা অপ্রতুল। পরিবহনের জন্যও দরকার থার্মাল শিপিং কনটেইনার বা আল্ট্রা ফ্রিজার ভ্যান।
এ কারণে কোভ্যাক্স থেকে বাংলাদেশের আবহাওয়ার উপযোগী অর্থাৎ সহজে সংরক্ষণ এবং পরিবহনযোগ্য টিকা চেয়েছে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম জানিয়েছেন, কোভ্যাক্স থেকে টিকা বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী না হলে ম্যানেজ করা কঠিন হয়ে যাবে।
এসআইএস/ এমকেএ