নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল-গ্যাসের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর সঙ্গে ক্রমেই বাড়ছে দাম। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) মূল্যহারও ঊর্ধ্বমুখী। গত জানুয়ারির চেয়ে চলতি অক্টোবরে গ্যাসের দাম প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। আরো বেশি পাঁচ গুণ বেড়েছে এলএনজির দাম। প্রতি ব্যারেল মার্কিন ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত তেলের দাম গত সাত বছরের মধ্যে সোমবার সর্বোচ্চ ৮১ ডলার ছাড়িয়েছে। সাগর-মহাসাগর পেরিয়ে মূল্যবৃদ্ধির সে উত্তাপ লাগছে বাংলাদেশের বাজারেও।
দেশের জ্বালানি খাতে আমদানি নির্ভরতা বাড়ায় এর প্রভাবও আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বেড়েছে বিদ্যুৎ এবং শিল্প উৎপাদন খরচও। অনেক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সরবরাহ না পেয়ে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। রান্না ও পরিবহণে সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত বিকল্প জ্বালানি এলপিজি এবং অটোগ্যাসের দাম দেশের ইতিহাসে এখন সর্বোচ্চ। এমন প্রেক্ষাপটে জ্বালানি বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, এই দাম বৃদ্ধির পথ ধরে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে খুচরা পর্যায়ে বাড়বে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম। আর পরিশোধিত তেল পেট্রোল, ডিজেল, অকটেন এবং জেট ফুয়েলের দাম এ বছরের ডিসেম্বরের শুরুর দিকে বাড়ানো হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান বলেন, আমাদের যে এলএনজি আমদানি করা হয়েছে এবং আনার প্রক্রিয়ায় রয়েছে তা দিয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত সরবরাহে কোনো সমস্যা হবে না। মাঝে কিছু সময় আন্তর্জাতিক খোলা বাজার থেকে এলএনজি আমদানি না করায় দেশে কিছুটা গ্যাস সংকট হয়েছিল। তবে এখন কোনো সমস্যা নেই। দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি সরবরাহের জন্য আরো দুটি বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই চুক্তি করা হবে। আগামী এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে তারা গ্যাস-এলএনজি সরবরাহ করতে পারবে।
তিনি বলেন, তেল-গ্যাসের আমদানি ও পাইকারি মূল্য এবং খুচরা দামের মধ্যে এখন বড় ফারাক তৈরি হয়েছে। এ তফাত দীর্ঘদিন চলতে পারে না। তাই মূল্য সমন্বয় করা হবে। তবে সেটি এখনই হচ্ছে না। সুবিধাজনক সময়ে করা হবে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতি লিটার পেট্রোল ও ডিজেলের দাম যথাক্রমে ১২০ রুপি ও ১১০ রুপিতে দাঁড়িয়েছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে তেলের দাম কম। তেলের দাম বাড়ানো না হলে চোরাচালানের ঝুঁকি বাড়বে।
জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনাকালীন সময়ে বাণিজ্যিক ও শিল্প উৎপাদনের গতি ধীর হওয়ায় খনি থেকে গ্যাস ও তেল উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছিল শীর্ষ উৎপাদক দেশগুলো। ফলে জাতীয় মজুতও কমিয়ে দিয়েছিল অনেক দেশ। আবার যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, জাপান ও চীনসহ জ্বালানি ব্যবহারে শীর্ষে এগিয়ে থাকা দেশগুলোতে সর্বশেষ শীতের মৌসুম দীর্ঘায়িত হওয়ায় খুচরা পর্যায়ে বা বাসাবাড়িতে গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। দেশগুলোর মজুতও তলানির দিকে যেতে শুরু করে। এছাড়া তেল, গ্যাস ও এলএনজি ব্যবসায় জড়িত আন্তর্জাতিক বড় কোম্পানিগুলোর দীর্ঘ সময় প্রফিট মার্জিন কম থাকার বিষয়টি এখন চাহিদা বৃদ্ধির সময়ে পুষিয়ে নিতে তৎপর হয়েছে তারা। আবার জাপান, ভারত ও বাংলাদেশসহ এশীয় দেশগুলোতে এলএনজির চাহিদা বাড়ছে। এটিও সার্বিক দাম বৃদ্ধিতে বড় প্রভাব ফেলছে।
সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অয়েল বা অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ৮১ দশমিক ৫১ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। অথচ ২০২০ সালের জুলাইয়েও প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ৩১ ডলার। গত বৃহস্পতিবার হটাৎ করে তরলীকৃত গ্যাসের দাম প্রতি এমএমবিটিইউ ৫৬ ডলার ছাড়িয়ে যায়। রবিবারে এটি ৩৫-৩৬ ডলারে নেমে এসেছে। অথচ এ বছরের জানুয়ারিতেও বিশ্ববাজারে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ছিল ১৪ ডলার।
এদিকে দেশে গরম বেড়ে যাওয়ার এ সময়ে বিদ্যুতের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে গ্যাসের সরবরাহে সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে সরকারি নির্দেশে গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো বন্ধ রাখা হচ্ছে। সর্বশেষ গত রবিবার দেশের ইতিহাসে সিলিন্ডার গ্যাসের দাম সর্বোচ্চ বাড়ানো হয়েছে।
বিএসডি / আইকে