দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘আর্টসেল’-এর ভোকাল ও গিটার বাদক লিংকন। ভালোবেসে ২০১৭ সালে বিয়ে করেছিলেন মিমোষা লিমু হাওলাদারকে। বিয়ের পর থেকে তারা সুখেই সংসার করছেন। রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) নিজের ফেসবুকে পেজে লিংকনকে নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছেন স্ত্রী মিমোষা। সেখানে তিনি স্বামীর প্রতি ভালোবাসার নানা দিক তুলে ধরেছেন। স্বামীকে নিয়ে তার আবেগঘন সেই পোস্টটি এরইমধ্যে ভাইরাল। পাঠকদের জন্য তার সেই স্ট্যাটাস তুলো ধরা হলো।
আমার আর লিংকনের বিয়েতে আমার পরিবার থেকে কারো সম্মতি ছিলো না। আমি কোর্ট ম্যারেজ করার আগে আমার বাড়িতে জানিয়েছিলাম আমি কাকে বিয়ে করতে চাই, রাজি না হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক একটা সাধারণ পরিবারের জন্য। আমি নিজেও প্রথমে রাজি হইনি যখন লিংকন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, এমনকি আমি আর আমার বান্ধবী হাসাহাসি করেছি এতো মোটা হয় কিভাবে মানুষ! ১২৩ কেজি ওজন! আবার আমার চেয়ে ১৫ বছরের বড়!
কোনভাবেই রাজি ছিলাম না, কিন্তু মানুষটা আমার খুব কেয়ার করতো। আমি যে হোস্টেলে থাকতাম সেখানে খাবার একটুও ভালো ছিলো না। সে বরাবরই চাইত আমার জন্য রান্না করে পাঠাতে, আমি না করতাম। আমার এতো বেশি কেয়ার করতো যা আমার বাবা-মা ছাড়া কারো কাছে কোনদিনই পাইনি। বেশিরভাগ জায়গায় আমি সবার কাছে অপ্রিয়, আত্মীয়স্বজনের কাছে ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো আমি এটা বরাবরই বলি, এবং সব বুঝেও যথাসাধ্য চেষ্টা করি কেউ সাহায্য চাওয়া মাত্র সাহায্য করতে, কিন্তু তবুও কারো প্রিয় হতে পারিনি যতোটা কম সময়ে প্রিয় হয়েছি লিংকনের কাছে।
যাই হোক কথা বলতে বলতে তার জীবনের দুঃখের কাহিনীগুলো জানলাম। বিয়ে করার কথা জিজ্ঞেস করলে বলল আমি তো মোটা, কে বিয়ে করবে, তুমি নিজেও তো রাজি হওনি! কষ্ট চেপে রাখতে ড্রিংক করত প্রতিদিন রাতে, আপনাদের এই সদা হাস্যোজ্বল, যেখানে যায় সবাইকে হাসায়, স্টেজে গেয়ে কত আনন্দ দেয় সবাইকে তার মনে কতটা কষ্ট ছিল কে তার খোঁজ জানে! মোটা হওয়াটা কেউ ইচ্ছে করে হয় না, কেউ খুশিতে বা খেয়েই শুধু মোটা হয় না, ওবেসিটি নামে একটা রোগ আছে যে কারণে মানুষ মোটা হয়।
আমার মনে খুব নাড়া দেয় মানুষটার কষ্টের কথাগুলো আর আমার প্রতি তার ভালোবাসা, যত্ন। আর যে কষ্টের কারণে একটা মানুষ প্রতিটা দিন ড্রিংক করে নিজের জীবনটা শেষ করে দিচ্ছিল তা ছিল একাকীত্ব। আমি ঠিক করলাম আমি এই মানুষটার জীবন এভাবে শেষ হয়ে যেতে দেবো না, আমার সঙ্গ যদি তাকে স্বাভাবিক জীবন দিতে পারে তাহলে তাই হোক। আর এতোটা ভালো আমাকে কেউ বাসবে না। সত্যি বলতে আমি নিজেও কখন মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলেছি বা তার প্রতি আমার একটা অন্যরকম ভালোবাসা তৈরি হয়েছে বুঝতে পারিনি। আমার পরিবারকে তার কথা জানালাম, কেউ মানবে না জেনেও। অতঃপর সিদ্ধান্ত নিলাম কোর্ট ম্যারেজের কারণ এছাড়া কোন উপায় ছিল না আমাদের হাতে। হ্যাঁ, মোটা জেনেই আমি তাকে ভালবেসেছি, কারণ এই মোটা মানুষটাই আমাকে আগলে রেখেছে।
কিন্তু আপনারা অনেকেই যখন আমাকে বলেন ভাবী/বৌদি লিংকন ভাইকে কম খেতে বলেন, কন্ট্রোল করতে বলেন, ভোটকা, ডায়েট করতে বলেন, পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল হতে বলেন, এসব আসলে আপনাদের লিংকনের প্রতি কেয়ার না। এগুলো এক প্রকার বডি শেইমিং, বডি শেইমিংয়ের মতো জঘন্য কাজ আপনারা করেন, যেটা আমি নিজেও করতাম যখন বুঝতাম না, এখন লিংকনের সাথে মিশার পর বুঝি একটা মানুষ ইচ্ছা করে মোটা বা চিকন, ফর্সা বা কালো, বেটে বা লম্বা হয় না, আমরা কেন তাদেরকে নিয়ে হাসাহাসি করব?!
আপনারাই বলেন লিংকন আপনাদের লিজেন্ড আবার নিজেরাই ওর মোটা হওয়া নিয়ে হাসাহাসি করেন, একেকজন তো উপদেশ দেন এমনভাবে যেন মোটা হওয়াটা ইচ্ছাকৃত!
শুধু লিংকন না আমার এই পোস্টের পর আশাকরি কেউ আর মোটা, চিকন, বেটে, লম্বা, ফর্সা, কালো মানুষগুলোকে হাসি বা উপদেশ দেওয়ার মাধ্যমে ছোট করবেন না। কারণ তারা নিজেরাই জানে তাদের কি করা উচিত, সবাই এক সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট তাই আমরা সবাইকে সম্মান করতে শিখি প্লিজ। আর প্রতিটা মানুষই কারো না কারো ভালোবাসার মানুষ, আর ভালবাসার মানুষকে নিয়ে কেউ যখন হাসাহাসি করে তখন সেটা ভালো লাগে না।
একজন তো আমার ইউটিউবে কমেন্টই করে বসেছেন লিংকনের এই মোটা হওয়ার কারণে সে বাচ্চু ভাইয়ের মতো অকালে মারা যেতে পারে, তার ভাবনাচিন্তার দৌড় কতদূর আমি শুধু তাই ভাবি। আপনার বা আমার এক মূহুর্তের নিঃশ্বাসের কোন গ্যারান্টি আছে কি যে আমরা বলতে পারি কে মারা যাবে আর কে বাঁচবে?
আর পরিবার এবং স্ত্রী সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীলতার কথা বলতে গেলে আমি বলব আমার আব্বু আর লিংকন এই দুইজন সবচেয়ে সেরা। আর আমার আব্বু সংসার জীবনে লিংকনের আইডল। তাই দয়া করে আমাদের পরিবার, আমাদের স্বাস্থ্য নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করার চেয়ে আপনাদের নিজেদের জীবন নিয়ে চিন্তা করাটাই কি শ্রেয় নয়!
আর বলেছিলাম শুরুতে আমার সঙ্গ লিংকনের জীবনকে পাল্টে দিতে পারে এদিকে আমিও সাকসেসফুল। আর লিংকনও সবসময়ই এতো বেশি ভালোবাসে আমাকে, নিজের চেয়ে বেশি ভাবে আমাকে নিয়ে এটা আর নতুন করে বলার কিছু নেই আমার। একটা মানুষ ভালো না বাসলে কোনদিনই নিজেকে পরিবর্তন করতে পারে না কারো জন্য।
মোটা চিকন না দেখে ভালোবাসার দৃষ্টান্ত দেখুন। যাকে ভালবাসবেন প্রাণখুলে ভালোবাসুন, কোন অবস্থায় যেন আপনার ভালোবাসার মানুষকে কেউ একটুখানি খোঁচা দিয়ে বা অপমান করে কথা বলতে না পারে।