নিজস্ব প্রতিবেদক
তখন ফোর কি ফাইভে পড়ি। সবকিছুতেই অপার কৌতুহল। চোখ গোল গোল করে ভাবি, এটা কি? ওটা কেনো এমন? এটা কেনো না? সব জানতে ইচ্ছা করে। সব। আপনারও নিশ্চয় এমন কিছু জানতে ইচ্ছা করতো। প্রতিটা শিশুই অপার আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়, সে কোত্থেকে এলো? কেমন করে এলো? কী উত্তর দেই আমরা? ঠিকঠাক দেই কী?
আমরা বউচি খেলছিলাম, এমন সময় কেউ একজন চিৎকার করে বলল, এই তোর পিছনে এটা কি? রক্ত! কেটে গেছে মনে হয়! আনোয়ারা, যাকে উদ্দেশ্য করে বলা, সে কাঁপতে লাগল রীতিমতো! আমরা হতবুদ্ধি হয়ে রইলাম। কিছুই বুঝতে পারিনি কিভাবে ও ব্যাথা পেলো। আর এত্ত রক্তই এলো কোত্থেকে? তবে বড় দুএকজনের ফিসফিসানি আর ওর মায়ের শাসানিতে বুঝলাম, ও আর আমাদের সাথে খেলতে পারবেনা সহজে। হয়েছিলোও তাই। আমরা খেলতাম আর ও তৃষিতের মতো তাকিয়ে থাকত। যদি বলতাম, আয় খেলবি। তখন ও বলত, মায় কইছে আমি নাকি বড় হয়ে গেছি। আমার খেলন বন্ধ। তোরা খেলগা।
বলতে বলতে ওর গলা বুজে আসত। ধুরর, বড় হওয়া তো বিরক্তিকর! আমি বড় হতে চাইনা। কিন্তু আমাকেও যে বড় হতেই হলো! আপনাকেও তো, তাই না? ঠিকঠাক কথাটা ঠিকঠাক শুনে, জেনে বড় হয়েছি কি? বেড়ে ওঠাটা আরো একটু সহজ হতে পারত কী?
বর্ষায় খালবিল সব পানিতে ভরে যেতো, আমাদের বাড়িগুলো ভেসে থাকতো দ্বীপের মতো। নতুন পানিতে দল বেঁধে আমরা গোসলে নামতাম। সে এক অদ্ভুত গোসল। পানিতে উদবেড়ালের মতো ডুবাতে ডুবাতে কখন যে ঘন্টা দুয়েক চলে যেতো বুঝতেই পারতাম না। নিজেরা না বোঝলেও, রক্ত জবা চোখ আর বরফ ঠোঙা শক্ত হাত পা দেখে বাবা মায়েরা ঠিকই বোঝতেন। ফলে উত্তম মধ্যম পিঠে ভালোই পরত। অবশ্য সেসব কিছুকে আমরা কিছু মনে করতাম না। বাবা মায়েরা শাসন না করলে আর থাকল কী, তাদের একটা দায়িত্ব আছে, না?
তেমনি এক গোসল উৎসবে মাকসুদার চিৎকার। নিজের বুকে এক হাত রেখে সমানে লাফাচ্ছে আর কাঁদছে। তার নাকি বুকে ফোঁড়া হয়েছে।
: এই দেখ দেখ, সুপারির মতো শক্ত!
: আরেহ, তাইতো! আহারে বইন, কান্দিস না।
খোদা! ভাগ্যিস আমার এমন হয়নি। মনেমনে শুকরিয়া করি।
নাহ্, আমার সে শুকরিয়া বেশিদিন লাষ্টিং করেনি। কোনো মেয়েরই মনে হয় করে না। আফসোস না করে বরং এক সময় ওড়নায় অভ্যস্ত হতে শিখে যায়। কে না জানে, আপনা মাংসে হরিণা বৈরী? মেয়েরা এব্যাপারে দারুণ! মডিফিকেশনে তারা ওস্তাদ। জন্মগতভাবে। দ্বিমত থাকলে হাত তোলেন তো দেখি ভাইসব, ভগিনিগন।
আমাদের নৈমিত্তিক সব খেলায় আনোয়ারা, মাকসুদা, জুলেখা, মমতাজরা যেমন থাকত, তেমনি থাকত রাসেল, রবিন, জুয়েলরাও। কোনদিন ভিন্নতা কাজ করেনি। না মনে, না মননে। পুতুল বিয়েতে নীরা যদি বরের মা হতো, অবলিলায় রবিন হতো বরের বাপ। অথচ বরের মা বাপ যে সত্যি সত্যি ভাইবোন এটা আমাদের বিন্দু মাত্র চিন্তার কারণ হতে পারত না, মাথায়ই আসত না। অথচ একদিন সত্যিই শুভর কন্ঠে চমকে ওঠলাম। ওর ফিনফিনে স্বর কখন যে ভরাট মেঘ গর্জনে পরিবর্তিত হয়েছে কে জানে? এদিকে আমরাও আস্তে আস্তে ভিন্ন রকম হতে থাকি। নিজের স্বর অচেনা লাগে। নিজের শরীর অচেনা লাগে। বয়োঃসন্ধি!
মারাত্মক দুর্জয় অবস্থার নাম বয়োঃসন্ধি! চিরপরিচিত শামিন আর শাম্মিয়াদের মাঝে বিভাজন তখন সূক্ষ গোঁফের রেখা আর ওড়নায় সীমাবদ্ধ নয়। রীতিমতো ভারত পাকিস্তানের বর্ডারের সংবিধিবদ্ধ সতর্কতা। সর্বত্র। বেচারা আমরা তখন দিশেহারা। নাটের গুরু হরমোন ইস্ট্রোজেন আর টেস্টোস্টেরন নাড়ে কলকাঠি, দোষ পড়ে আমাদের। বড়দের মতো আচরণ করলে বলে, ইঁচড়ে পাকা ছোটদের মতো হলে বলে, ন্যাকা।
বয়ঃসন্ধিতে ক্ষণে ক্ষণে মুড চেঞ্জ হতো। এই মনে হতো, ভাল্লাগেনা। আমার কেমন একলা লাগে। মন কেমন কেমন করে। এটা জানতে ইচ্ছা করে। ওটা ভাংগতে ইচ্ছা করে। নিজের শরীর অচেনা লাগে। বুকে ব্যাথা করে। ধরফর করে। চিনচিন রিনরিন ফিনফিন সবই করে। ভুল করতে ইচ্ছে করে। শুদ্ধতার জন্যও মন পোড়ে। দুঃখ ভালো লাগে। মনে হয় কী যেনো নাই, কী যেনো নাই। ফুল ভালো লাগে। পাখি ভালো লাগে। ও বাড়ির ছেলের তাকানো ভালো লাগে। পাশের বাড়ির মিরাকে না দেখলে পাগল পাগল লাগে। বড়দের শাসনে রাগ লাগে। মায়ের বকুনিতে অভিমান লাগে। আকাশ সমান অভিমান নিয়ে মরে যেতে ইচ্ছা করে। হুম। সত্যি বলছি।
মরে যাওয়া আর বেঁচে থাকার মতো দুটো ভিন্ন এই আবেগীয় স্রোতের সংঘর্ষের নাম বয়োঃসন্ধি। বয়োঃসন্ধির এই বানের জলে কতজন যে ডুবে যায়! আবার ডুবতে ডুবতে ভেসেও যায়। যদি সঠিক শিক্ষাটা পায়।
বয়ঃসন্ধি কি?
দশ থেকে চৌদ্দ বছর বয়সটাকে বয়ঃসন্ধি বলে। এই সময়টা হলো কৈশোর এবং যৌবনের সংযোগ কাল। একেবারে অস্থির সময় যাকে বলে।
বয়ঃসন্ধিতে কী হয়?
ছেলে ও মেয়েদের শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন শুরু হয়। কন্ঠস্বর পরিবর্তন হয়। পিউবিক হেয়ার, এক্সিলারি হেয়ার ডেভেলোপ করে। ছেলে বাচ্চাদের গালে সূক্ষ গোঁফের রেখা দেখা দেয়। মেয়েদের মাসিক বা ঋতুস্রাব হয়। বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রতি আগ্রহ জন্মে।
কেনো এমন হয়?
এটা অমোঘ নিয়ম। হবেই। ইস্ট্রোজেন (মেয়ে), প্রোজেস্টেরন এবং টেস্টোস্টেরন (ছেলে) নামক হরমোনের প্রভাবে এই পরিবর্তন সাধিত হয়।
বয়ঃসন্ধিকে বলা হয় সবচেয়ে সংবেদনশীল সময়। রবিঠাকুর বলছেন, তেরো চৌদ্দ বছরের মতো বালাই আর নাই। আসলেই নাই। এই সময়টাতে বাবা মাকে তার সন্তানের পাশে থাকা উচিৎ। ধৈর্য্য ধরে তাদেরকে এই আশ্চর্য পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে শেখানো উচিৎ। আমাদের সন্তানেরা যেনো পুরুষ কিংবা নারী হওয়ার পূর্বে ঠিকঠাক মানুষ হয়ে ওঠে। এই হোক আমাদের চাওয়া। কেনোনা, মানুষ হলে সব হয় আর অমানুষ হলে সব যায়।
বিঃদ্রঃ- আজকে এ পর্যন্তই। পরের পর্বে বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানের এবং বাবা মায়ের আচরণ এবং করনীয় নিয়ে লিখব। যা পরবর্তীতে আমাদের সন্তানদের জন্য গাইড হিসেবে কাজে লাগবে। বাবা মা হিসেবে আমরা হয়তো থাকবো না, কিন্তু আমাদের রেখে যাওয়া দিক নির্দেশনা ওদের বাতিঘর হয়ে পথ দেখালেও দেখাতে পারে। ওরা যেনো ভুলটা না শেখে এবং অসহায় না ফিল করে, শুধু এটুকুই চাওয়া। আপনার আমার সন্তান আলোকিত মানুষ হিসাবে বেড়ে ওঠুক।
ডা. ছাবিকুন নাহার
মেডিকেল অফিসার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল