নিজস্ব প্রতিবেদক: কারও করুনা বা দয়ায় নয় বরং নারীকে এগিয়ে যেতে হবে তার নিজের যোগ্যতা দিয়ে। প্রমাণ করতে হবে নিজেকে। যে নারীও পারে। নিঃসন্দেহে এতে নারীদের অনেক দুর্ভোগকে মানিয়ে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। নারীর আজকের অবস্থান কেউ তৈরি করে দেয়নি, আগামীর অবস্থানও কেউ তৈরি করে দিবে না। নারীকেই নিজের পথ তৈরি করতে হবে। কাজ করতে হবে সমাজ ও পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্যও। নিজের অধিকার বুঝে প্রাপ্য সম্মানের জন্য সমাজের মানসিকতা তৈরিতেও নারীদেরই লড়ে যেতে হবে। এবছর জাতিসংঘের “উচ্চ রাজনৈতিক ফোরাম” এর পার্শ্ববর্তী সভায় অংশগ্রহনকারী যুব প্রতিনিধি রেনেকা আহমেদ মনে করেন, জেন্ডার সমতার জন্য নারীদেরই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হতে হবে, দায়িত্ব পালনে তৎপর থাকতে হবে।
দৈনিক বর্তমান সময়কে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে রেনেকা আরো বলেন, একটি সুন্দর, গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার কাজে পুরুষের সমান অবদান রাখার প্রত্যয় নিয়ে নারীরাও এগিয়ে যাবার যোগ্যতা রাখে। তবে সমাজের বিদ্যমান নানা সঙ্কট নারীদের পদে পদে বাধা দেয়। তাই আজও নারীরা কর্মস্থল, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে আছে। হেনস্তা হচ্ছে রাস্তা-ঘাটে, যানবাহনে। মূলত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই নারীদের জন্য পৃথিবী ক্রমেই চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। সাক্ষাতকার নিয়েছেন দৈনিক বর্তমান সময়ের প্রতিবেদক শফিকুল ইসলাম।
বর্তমান সময়: একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে নারীরা আজও নির্যাতনের শিকার। কিন্তু কেন, সমস্যা কোথায়?
রেনেকা আহমেদ অন্তুঃ একবিংশ শতাব্দীর মূল প্রতিপাদ্য হলো নারী-পুরুষ সমান অধিকারের ভিত্তিতে হাতে হাত রেখে সামনে এগিয়ে যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজও আমাদের প্রতিদিনই শুনতে হচ্ছে, দেশের কোথাও না কোথাও নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, কোথাও না কোথাও নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, কোথাও না কোথাও যৌতুকের বলি হয়ে নারীরা আত্মহত্যা করছেন। এমন সংবাদগুলো অবশ্যই আমাদের জন্য সুখকর নয়। নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখলে দেখা যায়, নারীরা প্রধানত পরিবারেই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। যতোটা না শারীরিকভাবে নির্যাতিত, তার চেয়ে অনেক বেশি নির্যাতিত মানসিকভাবে। নারী নির্যাতনের ঘটনার জন্য আমাদের তাই গোড়ায় যেতে হবে। একজন ছেলে যেমন বড় হয়ে তার পরিবারে অবদান রাখতে পারবে, একজন নারীও তা পারবে, এ ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি না আসা পর্যন্ত নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো বাড়তেই থাকবে। নারী নির্যাতনের অন্যতম কারণ নারীদের অজ্ঞতা। যে নারী যতবেশি অজ্ঞ, সে ততবেশি নির্যাতিত। হোক সেটা অজপাড়া গা, মফস্বল কিংবা শহুরে জীবন। নারী নির্যাতনের আরেক কারণ পরনির্ভরশীলতা। নারী যত পরনির্ভর হবে, সমাজে-পরিবারে তার অবস্থান ততো তলানিতে থাকবে। তাই নারীদের আত্মনির্ভরশীল ও ব্যক্তিত্ববান হতে হবে। একইসঙ্গে পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। নিজের অবদান প্রয়োজনে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে আত্নবিশ্বাসের সাথে চলতে হবে।
বর্তমান সময়: নারী নির্যাতন বন্ধে এবং নারীদের সমঅধিকার নিশ্চিতকরণে পুরুষের কি ভূমিকা রাখা উচিত?
রেনেকা আহমেদ অন্তু: আমাদের দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাই নারীকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন কখনো সম্ভব না। নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ দিতে হবে রাষ্ট্রকে। কিন্তু জনসংখ্যার অর্ধেক পুরুষ। সমাজে একটা ধারণা আছে, পুরুষরাই কেবল অর্থনীতিতে তাদের ভ্যালু যোগ করছেন, দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে তারা কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু নারীরা যে কর্মস্থল থেকে শুরু করে পরিবারের নানা কাজ করছেন সেটাকে মূল্যায়ণ করা হচ্ছে না। পুরুষদের মনে রাখতে হবে, আপনি কাজ করছেন এবং আপনি বিরতি, অবসর ও নিচ্ছেন। অথচ একজন নারী ঘরের বাইরে যেমন কাজ করছেন, তেমনি ঘরেও করছেন। পাশাপাশি সন্তান লালন-পালন করছেন তারা। একইসঙ্গে তারা যেমন বর্তমান অর্থনীতিতে ‘ভ্যালু অ্যাড’ করছেন। অন্যদিকে সন্তানদের যোগ্য নাগরিক করে গড়ে তোলার মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের জন্য যোগ্য-দক্ষ-কর্মক্ষম নাগরিক তৈরি করছেন। নারীদের অবসর ভোগের অধিকার কোথায় যাচ্ছে? নারীদের অবদান আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, বিশেষত পুরুষদের। শ্রমের মর্যাদা দেয়ার সংস্কৃতি এলে আমার দেশের গৃহিনী থেকে শুরু করে কর্মজীবি নারী; কাউকেই অবজ্ঞা করার সুযোগ থাকবে না আর।
বর্তমান সময়: নারীদের সমঅধিকার নিশ্চিত এবং সমাজে নিজেদের পুরুষের সমকক্ষ করে গড়ে তুলতে হলে নারীদের কি কি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
রেনেকা আহমেদ অন্তু: নারীদের মনে রাখতে হবে পৃথিবীর কেউ কাকে কোন সিঁড়ি তৈরি করে দেয়নি। বিশেষ করে নারীদেরকে তো নয়-ই। তাই নারীদের নিজেদেরই সেই সিঁড়ি তৈরি করতে হবে। সেই সিঁড়ি তৈরি করতে হলে নারীদের সবার আগে যেটা করতে হবে, তা হলো যোগ্যতার্জন। যোগ্যতা, মেধা একজন নারীকে সমাজের সর্বোচ্চ পদে নিয়ে যেতে পারেন। তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তাই নারীদের সবার আগে দরকার যোগ্যতা ও মেধা অর্জন করা। নিজেকে আবিস্কার করে যাবার মনোভাব। নারীরাও মানুষ! সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্মগত অযোগ্য হিসেবে পাঠাননি। তাই আমাদের নিজেদের প্রথমে আত্নবিশ্বাসী হতে হবে। আমরাও পারি, নিঃসন্দেহে সমাজ আমাদের নানা বাধা-বিপত্তির সামনে দাড় করিয়ে পিছিয়ে আনতে চাইতেই পারে, তবে আমাদের পেছানো যাবে না!
বর্তমান সময়: নির্যাতনের শিকার নারীরা বিচার পাচ্ছে না, এমন অভিযোগ শুনা যায় এটা কতটুকু সত্য? আর কিভাবে নারী নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব?
রেনেকা আহমেদ অন্তু: আমাদের দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন রয়েছে। শুধু তাই নয়, এ আইনের আওতায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। সেখানে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করা হয়। কঠোর আইন থাকার পরও নারীরা নির্যাতিত হচ্ছেন সেটা সত্য। তবে সংখ্যাটা আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। আমি বলবো, গ্রামের নারীদের ক্ষেত্রে নির্যাতনের মাত্রা বেশি। সেখানে নারী ও তার পরিবার অসচেতন হওয়ায় আইনি ঝামেলায় যেতে চান না। তাই নির্যাতনকারী পক্ষের সঙ্গে দফায় দফায় মীমাংসা করার কাজে লিপ্ত হন। কিন্তু এটা কোন সমাধান নয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নতাও আছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল কার্যকর হওয়ার পর কিছুটা হলেও নির্যাতনের মাত্রা কমেছে তবে এখনো আমাদের আরো সুসস্পট আইন প্রয়োজন। ককাসের নিকট গার্লস এডভোকেসি অ্যালাইয়েন্স এর সহা়তায় ‘শিশু নির্যাতন আইন ২০১৯’ দাখিল করা আছে । সাক্ষ্য আইন ১৫৫(৪) ও সংশোধনের কাজ চলছে। তবে এসব পলিসির পাশাপাশি নির্যাতন পুরোপুরি বন্ধ করতে প্রয়োজন সমাজের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে পারলেই সব ধরণের নির্যাতন বন্ধ হবে।
বর্তমান সময়: বরাবরই কর্মস্থলে পুরুষের তুলনায় নারীদের কম মজুরি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ আছে। হোক সেটা তৈরি পোষাকখাত কিংবা গণমাধ্যম, আপনি কি বলবেন?
রেনেকা আহমেদ অন্তু: এটা সত্য নারীদের কর্মের অবমূল্যায়ণ করা হয়। তবে এ সমস্যাটা কেবল বাংলাদেশে নয়, পুরো বিশ্বেই নারীর কর্মের মূল্যের অবমূল্যায়ণ করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিবিসির বেশ কয়েকজন নারী কর্মী অভিযোগ এনেছেন, তাদেরকে পুরুষের তুলনায় কম বেতন দেওয়া হয়। দুই নারী সাংবাদিক বিবিসি থেকে পদত্যাগও করেছেন। আমাদের দেশেও অনেক ক্ষেত্রে নারীদের পুরুষের তুলনায় কম মজুরি দেওয়া হয়। ধারণা করা হয়, পুরুষরা বলবান। তাই তাদের বেতন বেশি। কিন্তু বাস্তবে এবং কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা পুরুষের চেয়ে কর্মে বেশি মনোযোগী। শুধু তাই নয়, তারা পুরুষের চেয়েও কখনো কখনো বেশি পরিশ্রম করতে পারেন। তাই নারীকে নারী নয়, একজন কর্মীর মতোই সম্মান দেখাতে হবে, মূল্য দিতে হবে এবং মজুরির ক্ষেত্রে এই নীতি মেনে চলতে হবে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার নারীরা। সেখানে প্রচণ্ড খাটুনির পরও তাদের কাজকে মূল্যায়ণ করা হয় না কখনো কখনো। কিন্তু এভাবে চলতে পারে না, তাই গার্মেন্টস খাতসহ সব খাতে নারীর কাজকে মূল্যায়ন করতে হবে। এজন্যে মিডিয়ার অবশ্যই জেন্ডার সমতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা বাড়াতে হবে। পুরুষতন্ত্র যে কেবল নারীদের নয় বরং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হিসেবে ভূমিকা রাখে তা তুলে ধরতে হবে।
বর্তমান সময়: নারীদের উন্নয়নে তাদের কি করা উচিত?
রেনেকা আহমেদ অন্তু: প্রথমেই বলেছি, নারীদের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। রাষ্ট্র কে নারীদের যোগ্যতা প্রদর্শনের সুযোগও বাড়াতে হবে। যোগ্যতা ছাড়া কোনো জায়গায় টেকা সম্ভব না, তাই যোগ্যতা, সক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি দরকার নারীদের আত্নবিশ্বাসী হওয়া। জীবনে শত বাধা আসবে, কিন্তু মনে রাখতে হবে পিছিয়ে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া। কোন পরিস্থিতিতেই পিছিয়ে যাওয়া যাবে না। প্রচণ্ড মেধাবী হতে হবে! জানতে হবে সারভাইবিং কৌশল। গোটা বিশ্বের সঙ্গে আপ-টু-ডেট থাকতে হবে। পরিবারে নিজের গুরুত্ব প্রয়োজনে চোখে আঙ্গুল দিয়ে তুলে ধরতে হবে। কেবল ঘরের কাজেই নয়, বাইরের জগতের সাথেও জানাশোনার বাড়াতে হবে। এ ছাড়া নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে নিজের চারপাশে একটি ব্যক্তিত্বের দেওয়াল তৈরি করতে হবে। যাতে ঠুনকো ধাক্কায় সেই ব্যক্তিত্ব ভেঙ্গে না পড়ে।
মনে রাখতে হবে, নারী পুরুষ একে অপরের প্রতিদ্বন্দী নয় বরং সহচর। সকল জেন্ডারের মানুষেরই সম্মান পাবার অধিকার আছে ও সম্মান করার দায়িত্ব আছে।
বর্তমান সময়: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
রেনেকা আহমেদ অন্তুঃ আপনাকেও ধন্যবাদ।