নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করে বলেছেন, নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশ ও ভারত নিজেদের সব সমস্যা সমাধান করতে পারবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ‘দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের’ প্রশংসা করে তিনি বলেন, এটা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে গেছে। অন্যদিকে মোদি আশাবাদী, আগামী ২৫ বছরের মধ্যে দুই দেশের বন্ধুত্ব নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে। তিনি আরও বলেছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে এ মন্তব্য করেন তাঁরা। বৈঠক শেষে সাতটি সমঝোতা স্মারকে সই করে দুই দেশ। বৈঠকে যৌথ কল্যাণে কাজ করতে একমত হয়েছেন দুই নেতা।
বৈঠক শেষে শেখ হাসিনা তাঁর বিবৃতিতে বলেন, ‘প্রায় তিন বছর পর ভারত সফর করতে পেরে আমি আনন্দিত। ভারতের ৭৫ বছরের স্বাধীনতার মহোৎসবে দেশটির জনগণকে অভিনন্দন জানাই।
শেখ হাসিনা বলেন, দুই দেশের মধ্যে ফলপ্রসূ বৈঠক হয়েছে। বৈঠকের ফল দুই দেশের মানুষের জন্যই সুফল বয়ে আনবে। আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে বৈঠক করেছি। আমরা সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে দ্বিপক্ষীয় সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। একে অপরের অগ্রাধিকার বিষয়গুলো পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে গ্রহণ করা এবং প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সম্ভাব্য উপায় নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি।
বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কানেক্টিভিটি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পানিসম্পদ, নিরাপত্তা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, লাইন অব ক্রেডিটের (নমনীয় ঋণ) মতো বিষয়গুলো আমাদের আলোচনার অংশ ছিল। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সরকার ও জনগণ যে সহযোগিতা দিয়েছে, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।
তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাছের প্রতিবেশী। বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক প্রতিবেশী কূটনীতিতে রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। গত এক দশকে দুই দেশ বেশ কিছু খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে দুই দেশ অনেক অনিষ্পন্ন বিষয় সমাধান করেছে। আমরা আশা করি, তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তিসহ বাকি সব অমীমাংসিত বিষয় দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমাধান হবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ যে, আমরা কুশিয়ারা নদীর সমস্যা সমাধান করতে পেরেছি। বাকি সব অভিন্ন নদীর সমস্যা সমাধান করতে পারব বলে আমি আশাবাদী।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, গত ৫০ বছরে দুই দেশ শক্তিশালী অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অভিন্ন স্বার্থের বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করছে। এ অঞ্চলে দুই দেশের সমৃদ্ধি, উন্নয়নের স্বার্থে আমি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বন্ধুত্ব ও অংশীদারিত্বের মনোভাব নিয়ে একত্রে কাজ করার বিষয়ে একমত হয়েছি। বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের মানুষের যৌথ কল্যাণে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত দীর্ঘদিনের বন্ধু। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময়ে আমরা অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। ১৯৭৫ সালে বাবা-মা-ভাই সব হারিয়ে আমরা অসহায় দুই বোন এ ভারতেই আশ্রয় পেয়েছিলাম। শুধু আমি নই, আমাদের পরিবারের আরও অনেকে আপনজন হারিয়ে, কেউ গুলি খেয়ে আহত অবস্থায় এখানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। দুঃখের সব সময়ে ভারত আমাদের পাশে থাকে।
কাজেই আমি মনে করি, আমরা বন্ধুপ্রতিম দুই দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে কাজ করব। শুধু এই দুই দেশ নয়; দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সব এলাকা মিলে যেন এ অঞ্চলের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে আরও উন্নত ও সমৃদ্ধশালী হয়; সবাই উন্নত জীবন পায়- সেটাই আমাদের লক্ষ্য। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক।
ভারত সফরের দ্বিতীয় দিনে গতকাল সকালে রাষ্ট্রপতি ভবনে যান শেখ হাসিনা। সেখানে নরেন্দ্র মোদি তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। এখানকার আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তিনি। এরপর আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে যোগ দিতে হায়দরাবাদ হাউসে যান প্রধানমন্ত্রী। সেখানেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। এরপর দুই প্রধানমন্ত্রী রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। বিকেলে ভারতের রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন তিনি।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সাতটি সমঝোতা স্মারকে সই করে দুই দেশ। পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিবৃতিতে বলেন, গত বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তি, আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী একত্রে উদযাপন করেছি। গত বছর ৬ ডিসেম্বর প্রথম মৈত্রী দিবস একত্রে উদযাপন করেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর ভারতের আজাদির মহোৎসবের মধ্যে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
মোদি বলেন, গত কয়েক বছরে আমাদের নিজেদের মধ্যকার সহযোগিতা সব ক্ষেত্রে দ্রুতগতিতে বেড়েছে। আজ বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন অংশীদার। সেই সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। আমাদের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ও মানুষে মানুষে যোগাযোগ দিন দিন বেড়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আমি দ্বিপক্ষীয় এবং আন্তর্জাতিক সব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। করোনা মহামারি এবং বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আমাদের অর্থ ব্যবস্থাপনাকে আরও শক্তিশালী করার বিষয়ে একমত হয়েছি। আমাদের মধ্যে কানেক্টিভিটি এবং সীমান্তে বাণিজ্য অবকাঠামো বাড়ানোর মাধ্যমে দুই দেশের অর্থ ব্যবস্থাপনা আরও কাছাকাছি আসবে এবং একে অপরকে সহযোগিতা করতে পারবে। আমাদের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য দ্রুতগতিতে বাড়ছে। বাংলাদেশের জন্য ভারত এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় বাজার। এটিকে আরও গতিশীল করতে আমরা সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (সেপা) নিয়ে শিগগিরই আলোচনা শুরু করব। আমরা তথ্যপ্রযুক্তি, মহাকাশ ও পরমাণু জ্বালানি নিয়ে সহযোগিতা বাড়াতে একমত হয়েছি। আমরা জলবায়ু পরিবর্তন এবং সুন্দরবন নিয়ে সহযোগিতা চালিয়ে যাব।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। যুগের পর যুগ এ নদীগুলো এখানকার মানুষের জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত। এ নদীগুলো নিয়ে গল্প, লোকগীতি আমাদের অভিন্ন সংস্কৃতিরও সাক্ষী। আজ আমরা কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে একটি সমঝোতা করেছি। এতে ভারতের দক্ষিণ আসাম এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল লাভবান হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৈঠকে আমরা সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ নিয়ে দুই দেশের সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছি। যে ধরনের শক্তি আমাদের নিজেদের মধ্যকার বিশ্বাসে চিড় ধরাতে পারে, তার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের চেতনা ধরে রাখা জরুরি। বঙ্গবন্ধু স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ এবং যে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে গেছেন, তা বাস্তবায়ন করতে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একত্রে কাজ করবে।
আজ বুধবার সকালে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নমন্ত্রী কিষান রেড্ডির সঙ্গে বৈঠক করবেন শেখ হাসিনা। এর পর হোটেলের একটি কক্ষে বাংলাদেশ-ভারত ব্যবসায়িক ফোরামের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন তিনি। এ ছাড়া বিকেলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া যুদ্ধাহত ভারতীয় সৈনিকদের পরিবারের সদস্যদের ‘মুজিব স্কলারশিপ’ প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন সরকারপ্রধান।
বিএসডি/এফএ