তরিকুল ইসলামের মৃত্যুর পর জেলা বিএনপির একটি পক্ষ তরিকুলের পরিবারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কিন্তু এখন তাঁর পরিবারের হাতেই দলের নিয়ন্ত্রণ।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোর সদর আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে শাহীন চাকলাদার ও কাজী নাবিল আহমেদের মধ্যে শুরু হওয়া কোন্দল আরও প্রকট হয়েছে।
যদিও দুই নেতা কোন্দলের বিষয়টি মানতে নারাজ। জেলার বিএনপির রাজনীতি তরিকুল ইসলামের পরিবারের হাতেই রয়েছে দলের। দলের স্থায়ী কমিটির প্রয়াত এই নেতা ও সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামের ছেলে এখন দলের খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক, স্ত্রী জেলার আহ্বায়ক।
আওয়ামী লীগের শাহীন বনাম নাবিল
কাজী নাবিল আহমেদ যখন যশোর-৩ (সদর) আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন শাহীন চাকলাদার তখন সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর সঙ্গে জনপ্রতিনিধি ও নেতা-কর্মীদের বড় অংশই ছিলেন। জেলার রাজনীতিতে শাহীন চাকলাদারের কথাই ছিল শেষ কথা। একাদশ জাতীয় সংসদে যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনে উপনির্বাচনে শাহীন চাকলাদার দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এরপর থেকে শাহীনের বলয় থেকে সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন, আরবপুর ইউপি চেয়ারম্যান শাহারুল ইসলাম, যশোর পৌরসভার কাউন্সিলর শেখ জাহিদ হোসেনসহ অনেকে নাবিল আহমেদের হাতে ফুল দিয়ে শাহীনের পক্ষ ত্যাগ করেন। কিছুদিন আগপর্যন্ত জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম কাজী নাবিলের সঙ্গে রাজনীতি করলেও এখন আবার নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে দলীয় কর্মসূচিতে শাহীন চাকলাদারের সঙ্গে একই মঞ্চে থাকছেন।
যশোর সদরের রাজনীতিতে প্রভাব কমলেও কেশবপুরের রাজনীতিতে আবার প্রভাব বেড়েছে শাহীন চাকলাদারের। উপজেলা কমিটির সভাপতি এস এম রুহুল আমিন ও কেশবপুর পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলামের মাধ্যমে তিনি অবস্থান শক্ত করেছেন। যদিও কেশবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী রফিকুল ইসলাম ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী গোলাম মোস্তফাসহ একটি অংশ শাহীন চাকলাদারের সঙ্গে নেই, তবু বিকল্প কোনো রাজনৈতিক পক্ষ এখনো গড়ে ওঠেনি।
জানতে চাইলে শাহীন চাকলাদার বলেন, ‘আমাকে কেউ ছেড়ে যায়নি বরং আমি নিজেই খারাপ লোকদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।’
দলীয় নেতারা জানান, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে শহরের দড়াটানা চত্বরে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের আলোচনা সভা হয়। সেখানে জেলা কমিটির সভাপতি শহিদুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার বক্তব্য দেন। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে শাহীন চাকলাদার ও শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা শহরের বঙ্গবন্ধু ম্যুরালে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এসব অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ তাঁদের সঙ্গে যোগ না দিলেও জাতীয় শোক দিবসে সদর উপজেলার নওয়াপাড়া, কাশিমপুর, হৈবতপুর ও চুড়ামনকাঠি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আয়োজনে পৃথক আলোচনা সভায় যোগ দেন।
কাজী নাবিল আহমেদ বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক কারও সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। আমি যশোরে থাকলে দলীয় কর্মসূচি পালনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলে যেটাতে অংশ নেওয়ার মতো সেটাতে নিই।’
দলীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যশোরের আটটি উপজেলার মধ্যে পাঁচটিতে আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোন্দলের কারণে তা ভেস্তে গেছে। ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে মোহিত কুমার নাথ সভাপতি ও শাহারুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
তিন বছর হতে চললেও কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি। ২০১৪ সালের ২৮ নভেম্বর সম্মেলনের মাধ্যমে কাজী মাহমুদুল হাসানকে সভাপতি ও গোলাম মোস্তফাকে সাধারণ সম্পাদক করে মনিরামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার আগেই ২০১৫ সালের ৬ ডিসেম্বর গোলাম মোস্তফা মারা যান। এরপর ২০১৮ সালের ১০ মার্চ কাজী মাহমুদুল হাসানকে সভাপতি ও ফারুক হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে চার সদস্যবিশিষ্ট আবারও আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়।
দীর্ঘদিনেও আওয়ামী লীগের এসব উপজেলা কমিটি পূর্ণাঙ্গ না হওয়ায় পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। সাংগঠনিক কার্যক্রমেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দলীয় কর্মসূচিতে ত্যাগী নেতাদের বেশির ভাগ এখন নিষ্ক্রিয় থাকছেন। এ ছাড়া কতিপয় নেতার আধিপত্যে বাড়ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল।
জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সামনে নির্বাচন। এখন খুব ভেবেচিন্তে পা ফেলতে হচ্ছে। নির্বাচনের আগে কমিটি দিলে যারা বাদ পড়ে যাবে, তারা বিদ্রোহ করতে পারে। এ জন্য নির্বাচনের আগে শাখা কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার পরিকল্পনা নেই। আমাদের মধ্যে কোনো গ্রুপিং নেই। কেন্দ্রীয় ও জেলার নেতাদের সঙ্গে কথা বলেই সুবিধাজনক সময়ে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হবে।’
বিএনপির নেতৃত্ব তরিকুল পরিবারের হাতেই
দক্ষিণাঞ্চলের বিএনপির রাজনীতিতে দলের স্থায়ী কমিটির প্রয়াত সদস্য তরিকুল ইসলামের অনেক প্রভাব ছিল। তরিকুল ইসলামের মৃত্যুর পর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাবেরুল হক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য টি এস আইয়ুবদের নেতৃত্বে দলের মধ্যে শক্তিশালী একটি পক্ষ গড়ে ওঠে। তারা তরিকুলের পরিবারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এখন আর সেই বিরোধ প্রকাশ্যে নেই। সরকারবিরোধী কর্মসূচিতে সবাই একসঙ্গে রাজপথে আছেন। কয়েক ডজন মামলার আসামি জেলার শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব নেতা।
তরিকুল পরিবারের হাতেই রয়ে গেছে যশোর বিএনপির রাজনীতির নাটাই। তরিকুল ইসলামের ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম এখন দলের খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আর স্ত্রী অধ্যাপক নার্গিস বেগম যশোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক।
যশোর বিএনপি এখন ঐক্যবদ্ধ দাবি করে জেলা বিএনপির সদস্যসচিব সৈয়দ সাবেরুল হক বলেন, ‘সরকারের চাপের কারণে আমরা জেলা, উপজেলা ও পৌর বিএনপির মোট ১৭টি ইউনিট কমিটি গঠন করতে পারিনি। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন না করতে পারলেও দলীয় কার্যক্রমে কোনো সমস্যা নেই। সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিচ্ছে। দলীয় কর্মসূচি করতে গেলেই আওয়ামী লীগ ও পুলিশ ঝামেলা করছে। এখন আমরা সরকার পতনের আন্দোলনে রয়েছি। এ মুহূর্তে কমিটি গঠনের মতো বাস্তবতা নেই। কেন্দ্র থেকেও এমন কোনো নির্দেশনা নেই।’
জেলায় বিরোধ প্রকাশ্যে না থাকলেও উপজেলা পর্যায়ে দলের ভেতরে বিরোধ রয়েছে। যে কারণে যশোর জেলা বিএনপিসহ ১৭টি উপজেলা ও পৌর কমিটির দীর্ঘ বছর ধরে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চালানো হচ্ছে। কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে পারেনি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
পাঁচ বছর ধরে জেলা বিএনপি আহ্বায়ক কমিটি দিয়েই চালানো হচ্ছে। সদর, শার্শা, ঝিকরগাছা, চৌগাছা, বাঘারপাড়া, অভয়নগর, কেশবপুর ও মনিরামপুর উপজেলা এবং এসব উপজেলার আটটি পৌর কমিটিও আহ্বায়ক কমিটি দিয়েই চলছে।
মনিরামপুর উপজেলা বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, ‘উপজেলা নেতাদের কোন্দল প্রকট। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিলেই দুই পরে মধ্যে গোলযোগ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এই শঙ্কায় আহ্বায়ক কমিটির নেতারা পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেননি। ফলে পদ পেতে ইচ্ছুক নেতারা হতাশ। এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
আরও পড়ুন
যশোরে বিএনপির নির্বাচনী প্রচারণায় হামলা, যুবদল নেতা হাসপাতালে
শার্শা উপজেলার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মনিরুল ইসলাম বলেন, গত দুই বছর দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান পর্যন্ত হয়নি। রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম নেই বললেই চলে। এর মূল কারণ হচ্ছে, নেতৃত্বের বিকাশ ঘটেনি। দীর্ঘ বছর ধরে কমিটি না হওয়ায় পদপদবি না পেয়ে অনেক হতাশ হয়ে পড়েছেন।
জানতে চাইলে অনিন্দ্য ইসলাম বলেন, ‘প্রশাসনের অতি উৎসাহী মনোভাবের কারণে আমরা উপজেলাগুলোকে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারছি না। এ মুহূর্তে আমাদের কারও মাথায় নির্বাচন নেই। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আমরা রাজপথে আছি। সেই দাবি আদায়ের সংগ্রামে আমরা জয়ী হলে নির্বাচনের জন্য আলাদা করে বিএনপির প্রস্তুতির দরকার হবে না।’
বিএস/এলএম