নিজস্ব প্রতিনিধি:
রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর দিল্লুর রহমানের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সোমবার (৯ নভেম্বর) দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই অনুসন্ধান টিম গঠন করা হবে।
দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত বিভাগের মহাপরিচালক সাঈদ মাহবুব খান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করে কমিশন থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই টিম গঠন করে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করা হবে।
এর আগে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেছিলেন, দুদক যেকোনো অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। আর যদি আদালতের নির্দেশ থাকে তাহলে ভিন্ন কিছু করার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা প্রতিপালন করা আমাদের দায়িত্ব।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর দিল্লুর রহমানসহ বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৮০০টি ভুয়া মামলা করেছেন। এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৪৯টি মামলা দেওয়ার তথ্যও রয়েছে। এসব মামলার পেছনে রয়েছে সাত হাজার একর জমি ও রাবার বাগান দখল। পীরের পক্ষে তার অনুগতরা এসব মামলা দায়ের করেছেন বলে জানা গেছে।
বিষয়টি দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। মামলাগুলো স্থগিত করে পীরের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। শুধু তা-ই নয়, এর আগে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন রাজারবাগ পীরের সব আস্তানা বন্ধের যে সুপারিশ করে, তা বাস্তবায়নের জন্যও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে পীরের অনুসারীদের বিরুদ্ধে করা আটটি মামলা তদন্তেরও নির্দেশ দেওয়া হয়।
চলতি বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর রাজারবাগ দরবারের পীর দিল্লুর রহমান এবং তার দরবারের সব সম্পত্তির হিসাব চেয়ে ওই আদেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে দরবার শরিফের সব সম্পদের তথ্য খুঁজতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), তাদের জঙ্গি সম্পৃক্ততা আছে কি না, তা তদন্ত করতে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট এবং উচ্চ আদালতে রিটকারী আটজনের বিরুদ্ধে করা হয়রানিমূলক মামলার বিষয়ে তদন্ত করতে সিআইডিকে নির্দেশ দেন আদালত। ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন দিল্লুর রহমান।
গত ২৬ অক্টোবর রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর দিল্লুর রহমান এবং তার প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা সম্পদের বিষয়ে তদন্ত করতে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। আদালত পীর দিল্লুর রহমানের বিরুদ্ধে তদন্ত স্থগিত চেয়ে করা আবেদন খারিজ করে দেন। ফলে, রাজারবাগ দরবার শরিফ ও পীরের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে কোনো বাধা থাকল না বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাজারবাগের পীর দিল্লুর রহমান এবং তার দরবার শরিফের সব সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করা হয়। পীর ও তার অনুসারীচক্রের বিভিন্ন ফৌজদারি মামলায় নাকাল আট ভুক্তভোগীর পক্ষে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদনটি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
রিট আবেদনকারীরা হলেন- মো. আব্দুল কাদের, মাহবুবুর রহমান খোকন, ফজলুল করিম, জয়নাল আবেদিন, মো. আলা উদ্দিন, জিন্নাত আলী, আইয়ুবুর হাসান শামীম, নাজমা আক্তার ও নারগিস আক্তার। পীরের সম্পদের হিসাব খতিয়ে দেখতে দুর্নীতি দমন কমিশন চেয়ারম্যানকে আদেশ দেওয়ার আর্জি জানানো হয় রিট আবেদনে। এছাড়া আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে কারা এবং কেন এসব ‘হয়রানিমূলক’ মামলা করেছে, তাদের চিহ্নিত করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত মহাপরিচালকের প্রতি নির্দেশনা চাওয়া হয়।
রাজারবাগ দরবার শরিফের পীরের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট
পীর দিল্লুর রহমানের অনুসারীচক্রের ‘অস্তিত্বহীন’ বাদীদের মামলা চ্যালেঞ্জ করে গত ৭ জুন প্রথমে হাইকোর্টে রিট করেন ঢাকার শান্তিবাগ এলাকার বাসিন্দা একরামুল আহসান কাঞ্চন। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট এসব ‘অস্তিত্বহীন’ মামলার বাদীদের খুঁজে বের করতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেন।
নির্দেশনা অনুযায়ী সিআইডির অনুসন্ধান প্রতিবেদন গত ৬ সেপ্টেম্বর আদালতে উপস্থাপন করা হয়। ওই প্রতিবেদনে শান্তিবাগ এলাকার বাসিন্দা একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, অ্যাসিড নিক্ষেপ, মানবপাচারের মতো বিভিন্ন অভিযোগে ৪৯টি মামলার পেছনে রাজারবাগের পীর দিল্লুর রহমানের সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে আসে।
ওই প্রতিবেদন দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে হাইকোর্টের বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম সেদিন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে পীর সাহেবের কাণ্ড দেখেন! জায়গা-জমি দখলের জন্য পীর সাহেব কী করেছেন দেখেন! সম্পত্তির জন্য তথাকথিত মুরিদ দিয়ে মামলা করিয়েছেন। পীর সাহেবের কেরামতি দেখেন!’
সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, একরামুল আহসান কাঞ্চনের তিন ভাই এক বোন। তাদের বাবা চিকিৎসক আনোয়ারুল্লাহ ১৯৯৫ সালে মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর কাঞ্চনের বড় ভাই আক্তার-ই-কামাল, মা কোমরের নেহার ও বোন ফাতেমা আক্তার রাজারবাগের পীর দিল্লুর রহমানের মুরিদ হন। কিন্তু একরামুল আহসান কাঞ্চন ও তার আরেক ভাই কামরুল আহসান বাদলকে বিভিন্ন সময় প্ররোচিত করেও মুরিদ করা যায়নি। কামরুল আহসান বাদল পেশায় চিকিৎসক।
রাজারবাগ দরবার শরিফের পেছনে ৩ শতাংশ জমির ওপর তিনতলা পৈতৃক বাড়ি কাঞ্চনদের। পীর দিল্লুর রহমানের মুরিদ হওয়ার পর কাঞ্চনের মা, ভাই-বোনের কাছ থেকে তাদের পৈতৃক জমির বেশির ভাগ অংশ পীরের দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করা হয়।
রাজারবাগ পীরের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে শিগগিরই টিম গঠন করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)
কাঞ্চন ও বাদলের অংশও দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করার জন্য পীর দিল্লুর ও তার অনুসারীরা বিভিন্নভাবে চাপ দেয়। কিন্তু কাঞ্চন ও তার ভাই সম্পত্তি হস্তান্তর না করায় পীর দিল্লুর রহমান ও তার অনুসারীরা ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় ‘হয়রানিমূলক’ মামলা দায়ের করেন।
সিআইডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় মোট ৪৯টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে জিআর (পুলিশি মামলা) মামলা ২৩টি এবং সিআর (নালিশি মামলা) মামলা ২৬টি। ইতোমধ্যে ১৫টি জিআর ও ২০টি সিআর মামলায় কাঞ্চন আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন। বর্তমানে ১৪টি মামলা আদালতে বিচারাধীন, যার মধ্যে আটটি জিআর ও ছয়টি সিআর মামলা।
পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অধিকাংশ মামলার নথিপত্র সংগ্রহের পর পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, আবেদনকারীর বিরুদ্ধে একাধিক মানবপাচার, নারী নির্যাতন, বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, হত্যার চেষ্টা মামলাসহ প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি, ডাকাতির প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন ধর্তব্য ও অধর্তব্য ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে। অধিকাংশ মামলার বাদী, সাক্ষী, ভিকটিমরা কোনো না কোনোভাবে রাজারবাগ দরবার শরিফ এবং ওই দরবার শরিফের পীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এছাড়া ২০২০ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি তদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজারবাগের দরবার শরিফের পীর দিল্লুর রহমান ও তার অনুসারীরা দরবার শরিফের স্বার্থ হাসিলের জন্য নিরীহ জনসাধারণের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করে আসছে মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে।
বিএসডি / আইকে