নিজস্ব প্রতিবেদক
মিয়ানমারের রাখাইনে জান্তা বাহিনীর হাতে জাতিগত হত্যার শিকার দেশটির রোহিঙ্গা নাগরিকদের মানবিক আশ্রয় দেশ বাংলাদেশ। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযানের পর বিপুল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন, যে সংখ্যা সাত লাখেরও বেশি। এর পর থেকে বিভিন্ন সময় অনুপ্রবেশ ও ক্যাম্পে জন্ম নিয়েছেন অনেকে। সে হিসেবে বর্তমানে ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের আশ্রয়ে থাকা এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে কয়েক দফা চেষ্টা করা হলেও তা কার্যকর হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য না হওয়ায় সংকটের সমাধান হয়নি বলে মতামত দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা।
এছাড়া তারা বলছেন, এই ইস্যুতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারকে কঠোর বার্তা দিতে হবে।
রোহিঙ্গা নীতির প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্যবিষয়ক এক জাতীয় সংলাপে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এ মন্তব্য করেন।
শনিবার রাজধানীর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি) দিনব্যাপী এ সংলাপের আয়োজন করে।
এতে নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ, উন্নয়ন সহযোগী, এনজিও, গণমাধ্যম, রোহিঙ্গা নেতাসহ বিভিন্ন পক্ষ অংশগ্রহণ করে।
সংলাপের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় সমন্বিত এবং ঐক্যবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা। ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, যা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চাপ সৃষ্টি করেছে।
সংলাপের সমাপনী অধিবেশনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা নীতি নিয়ে আমাদের জাতীয় ঐকমত্য নেই। ফলে আমরা যা অর্জন করতে পারতাম, তার থেকে অনেক কম অর্জন হয়েছে। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি জাতীয় ঐকমত্য তৈরির আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকট এখন খুবই জটিল। দ্রুতই এর সমাধান হবে না। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে তড়িঘড়ি করে চুক্তি সই ঠিক হয়নি। বাংলাদেশের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সমঝোতা না করলে বিপদে পড়তে হবে মিয়ানমারকে, বিশ্ব সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে দেশটিকে এ বার্তা না দিতে পারলে সমস্যার সমাধান হবে না।
আরাকান আর্মি রাখাইনে ফ্যাক্টর হতে যাচ্ছে উল্লেখ করে তৌহিদ হোসেন বলেন, তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক না হলেও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রাখতে হবে। কারণ মিয়ানমারে তাদের বড় অংশীদারিত্ব রয়েছে। আমরা কারও সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই না। কিন্তু কেউ যেন আমাদের ব্যবহার করার সাহস না পায়, সেজন্য নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে, আমরা এই নেতৃত্ব তৈরি করতে পারিনি। যা-ও তৈরি হয়েছিল আমরা তাদের রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছি।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে দরকষাকষি করতে হবে, আর তারা তা না করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেজন্য আমাদের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে এগোতে হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন যেন মিয়ানমারের জন্য লাভজনক হয়, সেই পদক্ষেপ নিতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আবদুল হাফিজ বলেন, রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিভক্তি, কার্যকর নেতৃত্বের অভাব ও রাখাইনে নিবর্তনমূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে না ওঠা তাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা।
এসআইপিজির ঊর্ধ্বতন গবেষক মিয়ানমারে সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ সুফিউর রহমান বলেন, জাতিসংঘ রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশে যতটা তৎপর, মিয়ানমারের ভেতরে ততটা তৎপর নয়। রোহিঙ্গা বিষয়ে একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরির তাগিদ দেন তিনি।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশ প্রধান সুম্বুল রিজভী জানান, বর্তমানে ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এখনও মিয়ানমারে রয়েছে, তাদের যাতে বাংলাদেশে আসতে না হয়, রাখাইনে তেমন পরিবেশ তৈরির জন্য দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দেন তিনি। রোহিঙ্গা সংকট সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে সমন্বয়হীনতা আছে বলে মনে করেন জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
সংলাপের প্রথম অধিবেশনে বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকটের অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মাত্রা নিয়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা হয়। সংলাপে আলোচকরা সংকটকে ঘিরে জটিল ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতা তুলে ধরেন। বক্তারা রোহিঙ্গা নীতি ও শরণার্থী নীতিমালার প্রয়োজনীয়তার প্রশংসা করেন।
অনুষ্ঠানে আলোচকদের মধ্যে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদসহ বিভিন্ন দলের নেতারা।
আমির খসরু বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট জটিল আকার ধারণ করেছে। তাদের ফেরত পাঠাতে দেশটির সরকারের পাশাপাশি সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশ আলোচনা করবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি টেকসই সমাধানের জন্য জাতীয় শক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
জামায়াত নেতা হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভবিষ্যতে নিরাপত্তা ঝুঁকি আরও বাড়বে। মানবিক দিকটির ওপর জোর দিয়ে রোহিঙ্গাদের মর্যাদার সঙ্গে আচরণ করার অধিকারের পক্ষে কথা বলেন তিনি।