মোহাম্মদ শেখ কামালউদ্দিন স্মরণ: আমরা বাঙালী জাতি,বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই আন্দেfলন ও হরতালের মাধ্যমে জনগণের দাবি-দাবা আদায় হয়। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের আন্দোলন কখনো উজ্জ্বল আবার কখনো নেতিবাচক চরিত্র নিয়েছে ৷ ছয় দফা আন্দোলনের কথা যদি বলি, ছয় দফা আন্দোলন ছিলো বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষে “৬ দফা দাবি” পেশ করেন।
৪ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের লাহোরে পৌঁছান এবং তার পরদিন অর্থাৎ ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ৬ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ফলে নিজেই ৬ ফেব্রুয়ারি এর সম্মেলন বর্জন করেন। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয়দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি সংগৃহীত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমদের ভূমিকা সংবলিত ছয় দফা কর্মসূচির একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। যার নাম ছিল ছয় দফাঃ আমাদের বাঁচার দাবি। ২৩শে ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধীদলীয় সম্মেলনে ৬ দফা পেশ করেন। এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়। ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা উত্থাপন করা হয় লাহোর প্রস্তাবের সাথে মিল রেখে। ছয় দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য- পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র, ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে এই ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। ছয়দফা কর্মসূচীর ভিত্তি ছিল ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। পরবর্তীকালে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার হয়।বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে একে ম্যাগনা কার্টা বা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদও বলা হয়।
তাই প্রতি বছর ৭ই জুন বাংলাদেশে ‘৬ দফা দিবস’ পালন করা হয়। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়। এই দিনে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হক, মুজিবুল হকসহ মোট ১১ জন বাঙালি শহিদ হন। ৬ দফা আন্দোলনের প্রথম শহিদ ছিলেন সিলেটের মনু মিয়া। বন্ধুগণ উপরোক্ত বিষয় নিয়ে আলোচনার কারণ হয়তো আপনারা বুঝতে পেরেছেন। যেখানে বাংলাদেশর জন্মই হরতাল আর আন্দোলনের মাধ্যমে,সেখানে বাঙালী জাতিকে দাবিয়ে রাখা সম্ভব কি? আমি বলব না,কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান নিজেই বলে ছিলেন,বাঙালী জাতিকে দাবিয়ে রাখতে পারবা না।
২০০৬ সালের এপ্রিল মাস,তখন বিএনপি সরকারী দল। উত্তর বঙ্গের কানসাটে চলছিল বিদ্যুৎ সংক্রান্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, স্থানীয় প্রশাসন বনাম মৌলিক অধিকারের দাবিতে আন্দোলনরত হাজারও মানুষ। চলমান আন্দোলন প্রতিহত করতে জারি হয় ১৪৪ ধারা। গ্রামের পর গ্রাম তল্লাশি চালিয়ে চলে গ্রেফতার। হাজারও মানুষের ক্রোধে ভঙ্গ হয় ১৪৪ ধারা। মিছিলের উপর বৈশাচিক আক্রমন চালায় পুলিশ, চালায় টিআরসেল, অবশেষে গুলি। সেই গুলিতেই ১২ এপ্রিল নিহত হয় ১১ বছরের কিশোর আনোয়ার। ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ, জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয় “কানসাটে পুলিশের গুলিতে নিহত কিশোর আনোয়ারের রক্তমাখা শার্ট হাতে দাড়িয়ে আছে তার মা, চোখে জল নেই, নেই শোক। ঘৃণা আর ক্রোধে লজ্জা পায় সভ্যতা।
১৯৯৪ সালে বিএনপি,সরকারী দলে থাকা অবস্থায়, জুন মাসে একটি সম্ভাব্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা প্রকাশ করে আওয়ামী লীগ।এরপর ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে ইসলামী-সহ রাজনৈতিক দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেওয়ার জন্য ২৭শে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএনপির সরকারের জন্য সময় নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু বিএনপি সরকার ছিল তাদের অবস্থানে অনড়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং বিএনপির নেতারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি কেবল নাকচই করেননি, বরং পুরো ধারণাটি নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে নানা রকম বক্তব্য দেন, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এরপর আওয়ামী লীগ বিএনপি সরকারকে আন্দোলনের সময়সীমা বেঁধে দেন। তাদের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে দাবি মানা হয়নি এই কারণ দেখিয়ে ১৯৯৪ সালের ২৮শে ডিসেম্বর সংসদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীর ১৪৭ জন সংসদ সদস্য।
কিন্তু পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে স্পিকার শেখ আবদুর রাজ্জাক তাদেরকে অনুপস্থিত হিসেবে বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত দেন। অনুমতি ছাড়া অনুপস্থিতির ৯০ কার্যদিবস পূরণ হওয়ার পর সংবিধানের বিধি মোতাবেক ১৯৯৫ সালের ৩১শে জুলাই সংসদীয় আসনগুলো শূন্য ঘোষণা করা হয়। এরপর ওই সব আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করে সরকার ও নির্বাচন কমিশন। কিন্তু বিরোধীদলগুলো উপনির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। বিরোধীদের আন্দোলনের মুখে উপনির্বাচনের চিন্তা থেকে পিছু হটে বিএনপি সরকার। এসব দলের ডাকা টানা হরতাল ও অবরোধের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু বিরোধীদল এবং সরকার পরস্পরের অবস্থানে অনড় থাকে।
প্রবল আন্দোলন এবং সহিংসতার মুখে ১৯৯৫ সালের ২৪শে নভেম্বর ৫ম জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হলে ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করে তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। আর এদিকে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে গড়ে তোলা আন্দোলনের অংশ হিসেবে হরতাল-অবরোধে বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় জনজীবন স্থবির ছিল, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল অর্থনীতি আর মানুষের জীবিকা। আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য দলগুলো তাদের আন্দোলন আরো জোরদার করে, আর অন্যদিকে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে থাকে বিএনপি। শেষ পর্যন্ত প্রধান প্রধান সব রাজনৈতিক দলের বর্জনের মধ্যে ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি একটি একতরফা এবং বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এরপর জুনে অুনষ্ঠিত হয় আরেকটি সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় ৪৮টি আসনে ভোট গ্রহণের আগেই ক্ষমতাসীন বিএনপি’র প্রার্থীরা বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে গেছেন। আবারও
বিতর্কিত সেই নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে বিএনপি পেয়েছিল ২৮৯টি আসন।নির্বাচনের আগেই দেশজুড়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল।তবে নির্বাচনের আগের দিন থেকে বিরোধীদল আওয়ামী লীগ ৪৮ ঘণ্টার হরতাল আহবান করলেও নির্বাচনটি শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। ভোটের পর আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ভোট দেওয়ার হার এতোটাই নগণ্য যে এটা প্রমাণ করে জনগণ এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের মুখে ১৫ই ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও আন্দোলনের মাঠ থেকে সরে যায়নি আওয়ামী লীগ।
রাজপথে আরও জোরদার আন্দোলন শুরু করে দলটি। শুরু হয় টানা হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলন। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সংঘাত জোরালো রূপ ধারণ করার প্রেক্ষাপটে মার্চ মাসের প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ঘোষণা করেন যে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল উত্থাপন করা হবে।কিন্তু আওয়ামী লীগ দাবি ছিল নতুনভাবে গঠিত বিএনপি সরকারের পদত্যাগ এবং সংসদ ভেঙ্গে দেয়া। আর এই দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখে আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল।
বন্ধগণ,এখন প্রশ্ন থাকে যে,বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের জনগণ ও কোনো রাজনৈতিক সংগঠন, সরকারী দলের বিপক্ষে আন্দোলন করা সম্ভব হবে কী ?না, হয়তো সম্ভব হবে না! যদি সম্ভব হতো তা হলে ক্ষমতা দখলে বিএনপি,জামাত,হেফাজত ইসলামের চলমান আন্দোলন অব্যাহত থাকতো। ২০০৮ সালের পূর্বের ঘটনা গুলো থেকে আমরা জানি যে,কোনো এলাকায় দেশ,জনগণ ও সরকারের ক্ষতিসাধন হবে এমন আশংকা হলে সেই এলাকায় সরকার ১৪৪ ধারা জারি করতেন। যা এখন কালের পরিবর্তে শুধুই ইতিহাস। তবে কেনো আন্দোলন করা সম্ভব হবে না,চলুন সেই বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করি।
এর আগে আমি আমার দাদার কাছ থেকে শুনা একটি গল্প আপনাদেরকে শুনাইতে চাই। প্রায় ৬০-৬৫ বছর পূর্বে প্রতিটি এলাকা সমাজ নিয়ে সংঘবদ্ধ ছিলো। প্রত্যেক এলাকায় একজন করে সমাজ প্রধান ছিলো,তারা শিক্ষিত ও অর্থ সম্পদ এর মালিক ছিলো। বলতে পারেন খুবই বুদ্ধিমান। এলাকার কোনো অশিক্ষিত লোকের দুরদূরান্ত থেকে চিঠি-পত্র আসলে তারা তা পড়তে পারতো না। তখন চিঠি পড়ানোর জন্য অশিক্ষিত লোক গুলো চিঠি নিয়ে ছুটতেন তাদের সমাজ প্রধানের কাছে,সমাজ প্রধান তার বুদ্ধি কাঠিয়ে অশিক্ষিত অসহায় মানুষ জনকে ঠকাতেন। সমাজ প্রধানের ভাষায়,অশিক্ষিত লোকগুলো দিনের পর দিন কুড়াল দিয়ে সমাজ প্রধানের প্রয়োজনীয় কাঁঠ কেটে দিতেন এবং কঠোরপ্ররিশ্রম করতেন। এখনো কি আপনার বুঝতে বাকী,কেনো আন্দোলন করা ও সফল হওয়া সম্ভব না? যদি তাই হয়, তবে আপনার জন্য চলমান সময়ের কিছু বিষয় তুলে ধরছি। বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত করা হয় ৮ই মার্চ-২০২০। তখন করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা ঢাকায় পাঁচটি হাসপাতাল প্রস্তুত করার ঘোষণা দেয়া হয় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে। হাসপাতালগুলো হলো—মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, মহানগর জেনারেল হাসপাতাল, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় যে, এসব হাসপাতালে প্রস্তুতির এখনো অনেক বাকি। অনেক হাসপাতাল রোগী ভর্তি করতে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত লাগবে বলে জানায়।
এরপর ১৬ই মার্চ বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা দেয়া হয় যে, ১৮ই মার্চ থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত সব স্কুল ও কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। আমাদের দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ই মার্চ-২০২০। ২১শে মার্চ-২০২০, শনিবার সরকারের এক ঘোষণায় জানানো হয়, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দশটি দেশের সঙ্গে সবরকম বিমান চলাচল ৩১শে মার্চ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
এসব দেশ হলো কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ওমান, সিঙ্গাপুর এবং ভারত। এসব দেশ থেকে যাত্রীবাহী কোন বিমান বাংলাদেশে নামতে দেয়া হবে না। এর ফলে কার্যত আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আমাদের বাংলাদেশ। তবে যুক্তরাজ্য, চীন, হংকং ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে বিমান চলাচল অব্যাহত থাকে। পরবর্তীতে চীন ছাড়া অন্য দেশগুলোর সঙ্গেও বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এর আগে ১৪ই মার্চ ইউরোপ থেকে বাংলাদেশে সব ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রথমে ৩১শে মার্চ-২০২০ পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পরে সেটি বাড়িয়ে ১৪ই এপ্রিল করা হয়।
১৪ই মার্চ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এক ঘোষণায় জানান, ইউরোপ থেকে ফ্লাইট আসা বন্ধের পাশাপাশি যেসব দেশ বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা দেয়া বন্ধ রেখেছে, তাদের জন্য বাংলাদেশ ভিসা দেবে না। সেই সঙ্গে সব দেশের নাগরিকদের জন্য অন-অ্যারাইভাল ভিসাও বন্ধ থাকবে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬শে মার্চ২০২০, সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে মিলিয়ে চৌঠা এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। পরবর্তীতে সেই ছুটি বাড়িয়ে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়।
২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে কোনো ধরণের আয়োজন না করার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।তবে এবারই প্রথম কোনো ধরণের আয়োজন ছাড়া বাংলাদেশে স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়। এ সময় সকল প্রকার যানবাহন, রেল, নৌ ও বিমান চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। জনসাধারণের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে সারা দেশজুড়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। সাধারণ ছুটির মধ্যে ঔষধ, কাঁচাবাজার ছাড়া সবরকমের দোকানপাট বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এসব দোকান বন্ধ করার জন্য সময় বেধে দেয়া হয়। বাতিল করা হয় পহেলা এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা।
১৯শে মার্চ-২০২০ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য প্রথম লকডাউন ঘোষণা করা হয় মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা। শিবচর উপজেলায় ওষুধের দোকান এবং নিত্যপ্রোজনীয় পণ্যের দোকান ছাড়া সব দোকান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো এলাকা লকডাউন করা হয়নি।তবে ৭ই এপ্রিল-২০২০ আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর নারায়নগঞ্জকে লকডাউন ঘোষণা করে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এরপর কমবেশী সারাদেশেই লকডাউন চলে।
লকডাউন চলাকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা
করোনাভাইরাসের আর্থিক প্রভাব কাটাতে পাঁচই এপ্রিল ৭২,৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে তিনি তৈরি পোশাক খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছিলেন।
প্রণোদনার এই অর্থ জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। মূলত ক্ষুদ্র, মাঝারি ও রপ্তানি খাতের জন্য এই প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়। এমন আকর্ষণীয় প্রণোদনা ঘোষণা করেও দুই-তিন মাসের বেশী সময় লকডাউন রাখতে পারেনি সরকার। কিন্তু বর্তমান লকডাউনের কথা যদি বলি,তবে কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে হবে।
গতকাল রাজধানীর,বারিধারা থেকে মিরপুর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল যাচ্ছিলাম। লকডাউনে রাস্তায় কোনো গণপরিবহন নেই বললে হয়তো ভূল হবে,গণপরিবহন আছে! নেই শুধু গরীবের কম পয়সায় চলাচলের একমাত্র বাহন“বাস”। কক্সবাজার থেকে আগত অসুস্থ ফারুক আজমকে দেখতে,রাজধানীর বারিধারা থেকে সিএনজি যোগে চললাম মিরপুর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ও হসপিটাল।
আমি ঢাকায় যতদিন যাবৎ বসবাস করছি,তত দিনের মধ্যে একদিনও দেখিনি যে,সিএনজির সামনে ডাইভারের দুই পাশে দু’টি মানুষ বসে ঢাকার ভিতর চলাচল করছে।অর্থাৎ সিএনজির সামনে পিছনে মিলিয়ে পাঁচ জন যাত্রী চলাচল করে। কিন্তু (৩ই মে) আমার তাও দেখতে হল
কিন্তু জনসাধারণের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে সরকার সারা দেশজুড়ে লকডাউন দিয়েছেন। লকডাউন যদি এমন হয় যে,রাজধানীতে বাস না পেয়ে মানুষ,এক রিক্সায় পাঁচ জন চলাচল করে! যেখানে এক রিক্সায় স্বাভাবিক ভাবেই দু’জন মানুষ যাতায়ত করতে কষ্ট হয়,সেখানে লকডাউনে বাস চলাচল না করায় দু’জনের রিক্সায় পাঁচ জন। হুম,এমটাই হচ্ছে লকডাউন নামক ঢাকার শহরে। ততখনে চিপা-চাপি করে সিএনজি যোগে আমি পৌছে গিয়েছি মিরপুর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন। সেখানে এ কী অবস্থা? এটা হাসপাতাল নাকি মাছের বাজার? মানুষ গিজগিজ করছে। এ যেনো ডাবল ভাড়ায় করোনা কিনতে আসলাম।
তারপর ফারুক এর সাথে দেখা করার আগ্রহ নিয়ে তার বেডের সামনে গেলাম। অসুস্থ ফারুক,মনে হলো নিঃশ্বাস নিতে খুবই কষ্ট হচ্ছে,মুখে অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে টেনে একটি পাইপ লাগানো। আহারে করোনা! মানুষকে দিতে জানো এতো যন্ত্রণা! ফারুক কথা বলতে পারছে না। আমাকে দেখে তার হাত উপরের দিকে তুলে সালাম দিল বুঝলাম,আরো বুঝলাম তার জন্য আল্লাহর নিকঠ দোয়া করতে। ফারুকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাসপাতাল থেকে নেমে আসলাম।
মিরপুর স্টেডিয়াম থেকে ফুটপাত ধরে হাটতে থাকলাম,এ যেনো ফুটপাত নয়,২০১৩ সালের (৫ই মে) হেফাজত ইসলামের ১৩ দফা দাবির আন্দোলন। একে তো করোনা ভাইরাস,দ্বিতীয়ত সরকার ঘোষিত লকডাউন,তার পরেও মার্কেটে এতো জনসমাগম? মনে প্রশ্ন জাগবে আপনারও,যেমন জেগেছে আমার। অবাধে মানুষ জন চলাচল করছে। তা হলে বাস চললে অসুবিধে কোথায়? বাসে দুই-সিটে একজন বসলেও তো অনেকটা সরকারী নিয়মে জনসাধারণের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত হত। কিন্তু রাজধানীর রাস্তা-ঘাটে বাস চলাচল না করায়,মানুষ যেনো একজনের কাঁধে উটে অন্য জন তার গন্তব্যে স্থলে পৌছানোর চেষ্টা। যেমন হতো পূর্বে সরকারী দলের হরতালে। বর্তমানে দেশজুড়ে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে যে লকডাউন চলছে,তাও যেনো লকডাউন নয়,সরকার দলীয় হরতাল
হাজার সাবধানতায় অবলম্বন করে,স্টেন্ড গিয়ে আবারও সিএনজিতে উঠলাম। কিছু দূর গিয়ে সিএনজি ড্রাইভারকে তার নাম জিজ্ঞেস করলাম,সে উত্তরে বললো,তার নাম মো.তৌহিদুল,রংপুরের মিঠাপুকুরে তার গ্রামের বাড়ি। সিএনজি ড্রাইভার তৌহিদুল রাজধানীর খিঁলগাওঁ সিপাহীবাগ ভাড়া বাসায় থেকে সিএনজি চালান। আমি আবার থাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,মামা তোমরা তো ভালো টাকা রোজগার করছো;সিএনজি ড্রাইভার,বললো,আমরা তো পুলিশের বৌ-বাচ্চা লালন-পালন করছি। গল্পে,গল্পে এসে পৌছে গেলাম। সিএনজি থেকে নামবো,এমন সময় দেখলাম আরো একটি সিএনজির ড্রাইভার এর পাশ থেকে আটারো-উন্নিশ বছরে যৌবতী মেয়ে নামলো। এতো সময় ভালো ছিলাম। কিন্তু এখন আর বিবেককে বুঝাতে পারলাম না। পুরুষ না হয় সিএনজি চালকের সাথে বসে আসবে কিন্তু একজন যৌবতী মেয়ে? যাইহোক মেয়েটি সিএনজি থেকে নেমে দাড়িঁয়ে রইলো। আমি তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। হাই,আমি স্মরণ।মেয়েটি জ্বি বলুন:আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি। কি বলবেন বলুন। আপনার নাম কী? মোছাঃ আয়শা আক্তার। গ্রামের বাড়ি? হবিগঞ্জ জেলা,মাধবপুর উপজেলা। ঢাকায় কী করেন? কিছু করিনা,বড় ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে আসলাম। আমি দেখলাম আপনি সিএনজি চালকের পাশে বসে আসলেন,সিএনজি চালক আপনার পরিচিত কী? না। তাহলে তার পাশে বসে আসতে আপনার অসুবিধা হয়নি? অসুবিধা হলে কী আর করব,গাড়ি পাইনা তাই বাধ্য হয়ে আসতে হলো। আমি কলাম লেখক,আপনার এই কষ্টের কথাগুলো কী আমি আমার সম্পাদকীয় কলামের এককোণে লিখতে পারব? অবশ্যই পারবেন, সরকার যে ধরণের লকডাউন দিছে এতে করে মানুয়ের করোনা বাড়বে কিন্তু কমবে না! আয়শা আপনার মোবাইল নম্বরটা হবে? উঠান,০১৭৬৮***০০১,ধন্যবাদ আবার দেখা হবে। চলে আসলাম বাসায়। রাত ১১:১৫ মিনিট হটাৎ মোবাইলে কল বেজে উঠল,হ্যালো,স্মরণ ভাই? জ্বি,স্মরণ ভাই বলছি, আমি কক্সবাজার থেকে কামাল বলছি,জ্বি, কামাল ভাই বলুন,ভাই ফারুক মারা গেছে। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নইলাহি রাজিউন।
মোহাম্মদ শেখ কামালউদ্দিন স্মরণ
লেখক ও কলামিস্ট,আমাদের সমাজ।