নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগের অবসান ঘটিয়েছে পদ্মা সেতু। ওই অঞ্চলের মানুষকে এখন আর ফেরি পার হওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। বাসে কিংবা ব্যক্তিগত বাহনে চেপে নিমিষেই পড়া দিচ্ছেন পদ্মা। গন্তব্যেও পৌঁছে যাচ্ছেন আগের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম সময়ে।
আগে দক্ষিণের যেসব যাত্রী ফেরির দুর্ভোগ এড়াতে চাইতেন তারা লঞ্চে যাতায়াত করতেন। কিন্তুপস্মা সেতু চালু হওয়ায় সেই যাত্রীরাও আর লঞ্চে যাতায়াত করছেন না। আগে যারা নদীপথে যাতায়াত করতেন তাদের বেশিরভাগের মধ্যেই এখন লঞ্চ যাত্রায় অনীহা দেখা দিয়েছে। যাত্রীরা সময় বাঁচাতে ও দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে ব্যবহার করছেন পদ্মা সেতু। আর যারা এখনও লঞ্চে যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই অসুস্থ কিংবা পরিবার-পরিজন নিয়ে যাচ্ছেন।
যাত্রী কমে যাওয়ায় সদরঘাট টার্মিনালে আগের মতো হাঁক-ডাক নেই। লঞ্চ মালিকরা বলছেন, সেতু উদ্বোধনের প্রভাবে লঞ্চের যাত্রী কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত সড়কে যানজট কমাতে পারলে মানুষকে লঞ্চ ভ্রমণে আগ্রহী করা যাবে। তবে ভোলা রুটে যাত্রীর সংখ্যা আগের মতোই রয়েছে।
সোমবার (৪ জুলাই) সরেজমিনে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে দেখা যায়, ঘাটে আগের মতো যাত্রী নেই। লঞ্চ কর্মকর্তারা বলছেন, মানুষ এখন সেতু দিয়ে কম সময়ে বাড়ি যেতে পারছে। তাহলে বেশি সময় নিয়ে কেন যাবে। কর্ণফুলী লঞ্চের কর্মকর্তা কাজল মিয়া বলেন, যাত্রী অনেক কমে গেছে। তবে ঈদকেন্দ্রিক যাত্রী বাড়বে বলে আশা করছি।
বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক (বন্দর) মো. আলমগীর হোসেনে বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের প্রভাবে লঞ্চে যাত্রী কমেছে। যার ফলে আমাদের টোল আদায়ও কমেছে। সেতু উদ্বোধনের আগে ২৪ জুন মোট টার্মিনাল টোল আদায় হয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। কিন্তু উদ্বোধনের পর ২৬ ও ২৭ জুন দুই দিনে আদায় হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা। আবার ২৮ জুন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পেয়েছি। ঈদযাত্রী বাড়ায় ২ জুন টার্মিনাল চার্জ ১ লাখ ৫১ হাজার টাকা পেয়েছি। দক্ষিণাঞ্চলের লঞ্চগুলোতে গড়ে ২০ শতাংশের বেশি যাত্রী কমেছে বলে জানান তিনি।
লঞ্চ মালিক সমিতির মহাসচিব ও পারাবত লঞ্চের মালিক শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, বিগত ৩৫ বছরে যত সরকার এসেছে সবাই নদীপথকে অবহেলিত করে রেখেছে। সরকার চায় না লঞ্চ ব্যবসা চালু থাকুক। গুলিস্তান থেকে সদরঘাটে আসতে মানুষকে যানজটের সঙ্গে একরকম যুদ্ধ করতে হয়। ড্রেজিংয়ের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি করা হচ্ছে কিন্তু ড্রেজিং করা হয় না। ফলে দিন দিন অবহেলিত হয়ে পড়ছে নদীপথ। নাব্য হারাচ্ছে নদীগুলো। এখনও সরকার চাইলে গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রাস্তার যানজট কমাতে পারে। যানজট কমলে নৌপথ জনপ্রিয় হবে। মেয়র ও পুলিশ কমিশনার চাইলে ২ ঘণ্টার মধ্যে রাস্তা যানজট শূন্য করতে পা। কিন্তু করছে না, কারণ যারা যানজট সৃষ্টিকারী তারা কারও আত্মীয় কারও শুভাকাঙ্ক্ষী।
তিনি আরও বলেন, আমার ছয়টি লঞ্চের মধ্যে তিনটি চলে, বাকি তিনটি বন্ধ। এখন আমরা চাইলে লঞ্চ বিক্রিও করতে পারব না। যাত্রী সংখ্যা কয়েকদিনের মধ্যে অর্ধেকে নেমে গেছে। এখন ব্যবসা হয় না, শুধু তেল খরচ আসে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল সংস্থার সচিব সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, সেতু উদ্বোধনের প্রভাবে লঞ্চের যাত্রী অর্ধেকে নেমে এসেছে। যাত্রী ধরে রাখতে লঞ্চ মালিকরা নয়া কৌশল হিসেবে ভাড়া কমিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, অনেকে নিজ উদ্যোগে ভাড়া কমালেও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ভাড়া কমানো হয়নি। সদরঘাট থেকে প্রতিদিন বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি রুটে ৫০-৫৫টি লঞ্চ চলাচল করে। যাত্রীর সংখ্যা বাড়লে স্পেশাল সার্ভিসের ব্যবস্থা করা হবে।
তিনি বলেন, বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে লঞ্চযাত্রা নিরাপদ এবং আরামদায়ক এ নিয়ে জনশ্রুতি থাকলেও যাত্রীরা সড়কপথে পদ্মা সেতু হয়ে রাজধানীমুখী হওয়ায় নৌযান মালিকরা কিছুটা চিন্তিত। তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কীভাবে মানুষকে লঞ্চ ভ্রমণে আগ্রহী করা যায় সেটি নিয়ে আমরা বিকল্প চিন্তা করছি।
ঢাকা-শৌলা-মুলাদী রুটে চলাচলকারী এমভি অভিযান-৩ লঞ্চের কেবিন ইনচার্জ নাছির হোসেন বলেন, সেতু উদ্বোধনের আগে আমাদের ৭০টি কেবিনই বুকিং হতো। কিন্তু এখন মাত্র ২০-২৫টি কেবিন বুকিং হয়। আগে যাত্রী হতো ৪০০-৪৫০ জন। বর্তমানে যাত্রী হয় ১৫০-২০০ জন। কেবিনের যাত্রীর পাশাপাশি ডেকের যাত্রীও অনেক কমে গেছে। এছাড়া অগ্রিম কেবিন ও টিকিটের চাহিদাও এখন কম। অন্য বছর এসময়টাতে লঞ্চের ভিআইপি, সেমি ভিআইপি, প্রথম শ্রেণির কেবিন, দ্বিতীয় শ্রেণির সোফার টিকিট পেতে রীতিমতো ঘাম ঝরাতে হতো যাত্রীদের। এবছর কাউন্টারগুলোতেও ঈদে বাড়িফেরা মানুষের টিকিটের জন্য তেমন একটা ভিড় নেই।
অন্যদিকে ঢাকা-ইলিশা রুটে চলাচলকারী এমভি আল ওয়ালিদ লঞ্চের সুপারভাইজার জিয়াউল হক বলেন, ভোলা রুটের লঞ্চে তেমন প্রভাব ফেলেনি পদ্মা সেতু। আমাদের যাত্রী আগের মতোই আছে। ভাড়াও অপরিবর্তিত আছে। ভোলা রুটে চলাচল করা লঞ্চগুলো ঘুরে জানা দেখা যায়, সেতু উদ্বোধনের প্রভাব তেমন প্রভাব যাত্রীদের ওপর পড়েনি। লঞ্চের ভাড়াও কমেনি। যাত্রীও আছে আগের মতোই। বরং ঈদ উপলক্ষে যাত্রীর চাপ কিছুটা বেড়েছে, তা আরও বাড়বে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
বরিশালগামী যাত্রী আকরাম হোসেন বলেন, লঞ্চে করে ঢাকায় পৌঁছাতে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা লাগে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় অর্ধেক সময়ে বাড়ি যাওয়া সম্ভব। পরিবার-পরিজন নিয়ে যাচ্ছি, তাই লঞ্চে করেই যেতে হচ্ছে। না হলে বাসেই যেতাম। হাফসা বেগম নামে পটুয়াখালীর এক যাত্রী বলেন, লঞ্চ ঘাটের কাছে আমার বাসা। বাসার পাশ দিয়ে বাস যায় না, তাই লঞ্চে যাচ্ছি। লঞ্চে বাসের তুলনায় ভাড়াও কম। লঞ্চ বাসের চেয়ে আরামদায়ক, হাঁটা-চলা করা যায়, নদীর দৃশ্যও উপভোগ করা যায়। তাই লঞ্চে বাড়ি যাচ্ছি।
লঞ্চ মালিক ও কর্মকর্তারা আশা করছেন, ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে দুএকদিনের মধ্যে যাত্রী বাড়বে। তারা বলছেন, সেতু উদ্বোধনের পর অনেকে আনন্দে সেতু দিয়ে চলাচল করছেন। কয়েকবার চলাচলের পর মানুষ আবার লঞ্চে বাড়ি ফেরাকে আপন করে নেবে। লঞ্চগুলো ঈদের আগের ও পরের কয়েকদিন খুব ভালো যাত্রী নিয়ে চলাচল করবে। তারপর হয়ত যাত্রী সংকটে পড়বে লঞ্চ।
বিএসডি/ফয়সাল