ডা. মুহাম্মাদ সাঈদ এনাম ওয়ালিদ
সেল্ফি শব্দের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। নিজেই নিজের ছবি তুলা কে বলে সেল্ফি। অনেকটা শখের বশে কেউ কেউ সেল্ফি তুলেন। কিন্তু সেলফ টক বা একাএকা কথা বলা এর সাথে আমরা তেমন কেউ পরিচিত নই। একা একা কথা বলা বা নিজে নিজে কথা বলা মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়া বা মুড ডিসওর্ডার এর লক্ষণ। তারা একা একা কথা বলতে থাকেন অনবরত। তাদের কথা গুলোর মধ্যে তেমন একটা সামঞ্জস্যতা নেই।
এরকম একা একা কথা বলা টুকটাক আমরা বলি। রাগে দুখে ক্ষোভে আমরা একা একা কথা বলে ফেলি। শিশুরাও খেলতে গিয়ে খেলনার সাথে বা পুতুলের সাথে একা একা কথা বলে। তবে সকথা গুলোর মধ্যে পারিপার্শ্বিক সামঞ্জস্যতা আছে। এটা মানসিক রোগের লক্ষণ নয়।
ঘোরতর মানসিক রোগীদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনবরত কথা বলতে দেখা যায়। বাংলাদেশে এ রোগীদের তাচ্ছিল্য করে পাগল ডাকা হয়। মুলত এ সম্পর্কে আমরা জানিনা বলেই এমন ডাকি। কেনো মানসিক রোগীরা একা একা কথা বলতে থাকে?
মানসিক রোগীদের মধ্যে হয় এমন হয় কারন তাদের অডিটরি হ্যালুসিনেশন। অডিটরি হ্যালুসিনেশন মানে হলো অবাস্তব কিছু শুনতে পাওয়া। অর্থাৎ অস্তিত্ব নেই এমন কিছুর আওয়াজ শোনা। ব্যাপার টা স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রেও হতে পারে। এই যেমন ধরুন আপনি গভীর চিন্তায় মগ্ন হঠাৎ শুনলেন কে জানি ডাকলো, কিংবা কিসের আওয়াজ কানে আসলো। আপনি তাকিয়ে দেখলেন কেউ নেই। অনেকটা শ্রুতি ভ্রম মনে হয় আপনার কাছে। গভীর রাতে এরকম হয়। অঘুমা রোগ, দুশ্চিন্তা, এনজাইটি এসবে টুকটাক এরকম হতেই পারে। কেউ কেউ এসবে অনেক সময় ভুত ভুত বলে দৌড় দিয়ে হাত পা ভাংগের নিজের বা অন্য কারো। দিনে গল্প করে বেড়ান, কাল রাতে আপনাকে ভুত তাড়া দিয়েছে। আসলে এটা হ্যালুসিনেশন।
কিন্তু মানসিক রোগীদের ক্ষেত্রে এই হ্যালুসিনেশন অনবরত হতে থাকে। তারা অনবরত শুনতে থাকেন, তাদের সাথে কেউ কথা বলছে, কিংবা তাদের নিয়ে কেউ কথা বলছে। তাই তারা এসব কথার উত্তর ও দিতে থাকেন। অগোছালো অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিংবা সামঞ্জস্যতাপূর্ন। যারা মদ পান করেন বা যারা মাদকসেবীদের তাদেরও অনেক সময় হ্যালুসিনেশন হয়।
হ্যালুসিনেশন অনেক ধরনের হয়ে থাকে। অবাস্তব কিছু দেখাও হ্যালুসিনেশন। একে ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন বলে। এই যেমন আপনি দেখলেন আপনার মৃত মা বাবা বা কোন আত্মীয়স্বজন আপনার সামনে হঠাৎ দাঁড়িয়ে আছেন। কিংবা আপনি দেখলেন, আপনি প্যারিসের রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বাদাম বিক্রি করছেন। এটা এক্সট্রা ক্যাম্পেইন হ্যালুসিনেশন।
রিফ্লেক্স হ্যালুসিনেশন বলে ইন্টারেস্টিং একটা হ্যালুসিনেশন আছে, এটা হলো আপনার চোখের সামনে নীল রঙ আলো বা পর্দা, কিছু ভাসলো ওমনি আপনি একটা মিউজিক শুনতে পেলেন। নিজেই নিজের শরীর কে দেখতে পাওয়াকে বলে অটোস্কোপিক হ্যালুসিনেশন। এগুলো ঘোরতর মানসিক রোগে হয়। তবে ডিপ্রেশন, এনজাইটি, মানসিক চাপ, অঘুমা এসবেও হয়। ডিমেনসিয়া বা পারকিনসন রোগেও এমন হতে পারে।
যেমন অনেক সময় ডিমেনসিয়ার পেশেন্ট এসে বলেন, কাল রাতে আমি আমার বড় ছেলেকে ঘুরতে ফিরতে দেখলাম। অথচ তার বড় ছেলে হয়তো অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। ডিমেনশিয়া আক্রান্তরা সাধারণত ঘরের মুরুব্বী দাদা বা নানা প্রকৃতির হন। এদের এ আচরণ আর কথা বার্তায় অনেকে অনেক সময় ভুল করে তাদের পাগল হয়ে ভাবেন। কারন তাদের ও অনেক সময় হ্যালুসিনেশন হয় এমন কি ডিলিউসন হয়। ডিলিউসন হলো অলীক বিশ্বাস। এতে তারা অনেক সময় না বুঝে উলটোপালটা কথা বলেন, কাজকর্ম করে বসেন।
পারসিকিউটরি ডিলিউসন এর জন্যে ডিমেনসিয়া আক্রান্ত বয়স্করা অনেক সময় বিশ্বাস করেন এবং বলেন, তার সকল সম্পত্তি তারই ছেলে মেয়েরা আত্মসাৎ করতে চাচ্ছে, তাকে তাকে মেরে ফেলতে চাচ্ছে।
একবার এক ডিমেনসিয়া পেশেন্ট কে তার ছেলেরা অনেকটা বেঁধে জোর করে নিয়ে আসলো চেম্বারে। বললো, বাবা পাগল হয়ে গেছেন, ভীমরতি তে পেয়েছে। তিনি নাকি এক ছেলের বউকে জড়িয়ে ধরেছেন। আসলে বৃদ্ধা ছিলেন ডিমেনসিয়ার পেশেন্ট। ঘটনার কিছুই তিনি মনে করতে পারলেন না। একে বলে লস অব ইনহিবিশন। সাধারণত ফ্রন্টো-টেমপোরাল টাইপের ডিমেনসিয়াতে ব্রেইনের ফ্রন্টাল লোব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে এমন হয়।
মানসিক রোগ বা স্কিজোফ্রেনিয়াতে অনবরত হ্যালুসিনেশন হয় ব্রেইনের ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটার মাত্রাতিরিক্ত হওয়াতে। এজন্যে ডোপামিন রিসেপ্টর ব্লকার ঔষধ দেওয়া হয়। এতে অবিশ্বাস্য রকম ভাবে হ্যালুসিনেশন বন্ধ হয়ে যায়। রোগীদের একাএকা কথা বলা কমে আসে। এক সময় সে সাধারণ মানুষের মতই সুস্থ হয়ে উঠে।
বিষয়টি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর চেম্বারে কিংবা একটি মানসিক রোগ হাসপাতালে গেলে অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করা যাবে। যে রোগী টি এক মাস আগে অসংলগ্ন কথা বার্তা আর আচারণ নিয়ে আসছিলো, যাকে অনেকটা ধরে বেঁধে মেরে চেম্বারে আনা হয়েছিলো, এক মাস পর সে কী সুন্দর সুস্থ। দিব্যি সবার সাথে চলাফেরা করছে, গালগল্প করছে, কাজকর্ম করছে।
মানসিক রোগ গুলো সত্যিই অদ্ভুত। হাত পা, চোখ নাক কান সবই ঠিক আছে কিন্তু কোথায় যেনো একটু গরমিল। যার জন্যে সবকিছুতে গরমিল।
আল্লাহ তায়লা অসীম ক্ষমতাবান। তিনি কিনা করতে পারেন।
লেখক- ডা. মুহাম্মাদ সাঈদ এনাম ওয়ালিদ
চিকিৎসক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কলামিস্ট, জনস্বাস্থ্য গবেষক।
বিএসডি/এমএম