আরাফাত হিল্লোল
পুকুর ঘাটের শান বাঁধানো সিঁড়ির একপাশে মাথা নিচু করে বসে আছে শান্তা, উলটো পাশে বসেছে আতিক। কেউ কারো দিকে চেয়ে দেখছেনা। তাদের হাবভাবে কে বলবে যে, এই এরাই তিন বছর চুটিয়ে প্রেম করে গাটছাট বেধে বিগত দুই বছর একই ছাদের নিচে ঘর করে আসছে!
কিছু সময় পরেই তিন নম্বর প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াবে সীমান্ত এক্সপ্রেস। এই সীমান্ত এক্সপ্রেসে করেই তাদের দাম্পত্য পৌঁছে যেতে যাচ্ছে সম্পর্কের শেষ সীমান্তে।
আতিককে পিছে রেখে এই ট্রেন শান্তার সাথে বয়ে নিয়ে যাবে তাদের অজুত নিজুত হাসি বেদনার গল্প, লাল নীল অগুনতির স্মৃতি।
কী এক খেয়ালে আতিক টুপ করে বরই সাইজের একটা পাথর ছুড়ে মারলো সামনের শান্ত বিশাল পুকুরটায়। কী আশ্চর্য! এইটুকুন পাথরটা বিশাল পুকুরটার কতখানি জায়গা জুড়ে নাড়িয়ে দিলো। আরে তাই তো! আগে তো কখনো এভাবে ভেবে দেখেনি আতিক। হঠাৎই সে নিজের জীবনের সাথে পুকুরটার এক অদ্ভুত সাদৃশ্য আবিষ্কার করলো। কত তুচ্ছ ক্ষুদ্র বিষয়াদি মানুষের জীবনকে এভাবে নাড়িয়ে এলোমেলো করে দেয়।
দুপুর ১২ টা গড়িয়ে ঘড়িতে এখন ৩ টা বেজে গেছে কিন্তু ট্রেনের দেখা নেই। আরও নাকি প্রায় ১ ঘন্টা সময় লাগবে, ক্রসিং এ আটকে আছে। আতিকের কেমন যেন বসে থাকতে থাকতে অধৈর্য লাগছে। “তুমি একটু বসো, আমি একটু ওদিক থেকে হেটে আসছি” বলে আতিক উঠে পুকুরের পাড় ধরে হাটা শুরু করলো। বহুবার সান্তাহার স্টেশন দিয়ে সে এর আগে যাতায়াত করেছে কিন্তু মূল প্লাটফর্ম এর বিপরীতের এই উপেক্ষিত পুকুরের দিকে আসা হয়নি কখনো। পুকুরপাড়ের এক দিকে একটা ঝুপড়ি ঘরের মত। পুরোপুরি ঝুপড়ি নয়। টং ঘর আর ঝুপড়ির মিশেলে অদ্ভুত কায়দার এক ঘর। ঝুপড়ি ঘরের কয়েক মিটার সামনের ফাকা জায়গায় মধ্যবয়সী কেউ একজন দাঁ দিয়ে যত্ন করে বাঁশ ছিলে ছিলে সাইজ করছে। কৌতূহল নিয়ে সামনে এগিয়ে গাছের একটা গুড়ির উপর যেয়ে বসলো আতিক। কিছুক্ষণ ভদ্রলোকের মত বসে থেকে একঘেয়েমি কাটাতে খাঁকারি দিলো
– কী বানাচ্ছেন ভাই এগুলো?
– কিছু না ভাই, ঘরের চালের প্যালা দেবো।
– প্যালা জিনিসটা কী ভাই?
– প্যালাই তো আসলরে ভাই। সামনে বৃষ্টির দিন আসতিছে, প্যালা না দিলি পরে হামাক ঘর টিকবেনা বৃষ্টির তোড়ে। ম্যালা কষ্ট হবে ভাই।
– প্যালা না দিলে কী ক্ষতি?
– আল্লাহ, কন কী ভাই? তা এত বড় ঘরটারে ঠেইলে ধরে রাখার জন্যি কিছু দেবেন না? নাহলি হবে ক্যাবা?
আতিক অস্ফুটে “হুম” বলে কিছুসময় চুপ থেকে আবার আলাপচারিতা আগাতে চাইলো
– ভাই নাম কী আপনার?
– ফসিয়ার। সবাই ফইছে ফইছে ডাকে বলে ফিক করে হেসে দিলো লোকটা।
– এক গ্লাস পানি খাওয়ানো যাবে ফসিয়ার সাহেব?
দাঁড়ান দিচ্ছি বলে ‘অন্তরার মা, এক গিলাস পানি দেও দিন এদিকে জলদি করে’ বলে হাক পাড়লো।
কিছু সময়ের মধ্যেই কোলে ২-৩ বছরের একটা মেয়েকে নিয়ে ৩০ এর কাছাকাছি বয়সী এক মহিলা পানি ভর্তি গ্লাস নিয়ে এলো। মহিলার হাত থেকে গ্লাস নিতে আতিকের কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিলো, ফসিয়ারই বললো “ল্যান ভাই, ল্যান। এডেই আমার বউ।”
অন্তরার মা গ্লাসটা না নিয়েই মেয়েটাকে বাপের কাছে রেখে চলে গেলো। মেয়েটা শুধু একটা হাফ প্যান্টস পরা অবস্থাতেই ধুলাবালির মধ্যে মাটির উপর বসে হাত পা ছড়িয়ে খেলতে শুরু করলো। ফসিয়ার মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে বলে উঠলো
ঐ যে প্যালার কথা পাড়ছিলাম না, এই মাইয়্যাডা আর মাইয়্যার মা হইলো আমার জীবনের প্যালা।মাইনসের জীবনেও তো প্যালা লাগে। যহন দ্যাখবেন জীবনডা ভার হইয়ে আপনারে চাইপে ধরতে চাচ্ছে তহন দ্যাখবেন এসব প্যালাই আপনারে বাঁচাইবো।
আসলেই তো লোকটা ঠিক বলেছে। কত সরল হিসাব, কিন্তু কত কঠিন করে ভাবি আমরা মানুষেরা।
– ভাই, আপনে বিয়া করছেন?
আতিক এমন একটা ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো যে তার অর্থ হ্যাঁ বা না যে কোনোটাই ধরে নেয়া যেতে পারে।
কখন যেন শান্তা এসে আতিকের পাশে বসেছে সে বুঝতেই পারেনি।
এলোমেলো বাতাসের ঝটকায় পরিচিত পারফিউমের ঘ্রাণে চমকে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে শান্তা গাছের গুড়ির উপর আতিকের পাশেই বসে আছে। কেমন যেন উদাসীন, কাহিল ভঙিতে বসে আছে মেয়েটা। স্থির বসার ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে সে আতিক এবং ফসিয়ারের সর্বশেষ বাক্যালাপ শুনেছে। বিরক্তি আর ভালবাসার একটা মিশ্র অনুভূতি নাড়া দিয়ে গেলো তাকে। শান্তার উপস্থিতির বিষয়টাকে পাত্তা না দেয়ার ভঙ্গিতে ফসিয়ারকে জিজ্ঞাসা করলো
– ঐ ছোট্ট ঘরটাতেই কি আপনারা থাকেন? সবাই, মানে বউ-বাচ্চা সবাই?
– হয় ভাই, ওই ঘরডাই তো আমার বাড়ি, সংসার সব।
– কী কী আছে ওইটুকুন ঘরের মধ্যে?
– স্টেশনের বাতিল লোহার এট্টা বেঞ্চ দিয়ে বানানো খাট, বিয়ের সময় কেনা এট্টা ট্রাঙ্ক, ৩০০ টাকার বাংলা আলনা…বলার মতো এই ই ধরেন।
– এ ই? ভীষণ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে শান্তা?
আলাপের মাঝখানে উপযাচক হয়ে শান্তার এমন আগ বাড়িয়ে কথা বলাতে অস্বস্তি বোধ করে আতিক।
– আর কিছুর দরকার তো লাগেনা আমগো। খুব ভালই তো আছি আমরা।
ফসিয়ারের কথায় চট করে শান্তার মনে পড়ে যায় তাদের বাসায় হাতিলের দামী খাট কেনা নিয়ে তার আর আতিকের মাঝে ঘটে যাওয়া বিবাদের কথা। চাকরির শুরুর দিকে বলে আতিক এসব ফার্নিচার কেনার বেলায় এত খরচা করতে রাজি ছিলোনা কিন্তু শান্তা কেন যেন মেকি এরিস্টোক্রেসি কমপ্লেক্সে ভুগতো। এটা এখন শান্তার নিজেরই উপলব্ধি হচ্ছে। অনেক বাদানুবাদের পর হাতিলের খাট ঠিকই এসেছে ঘরে কিন্তু সে খাঠ কখনো বিছানা হয়ে উঠতে পারেনি।
অন্তরার মা ঝুপড়ির বেড়াতে ঝুলানো ভাঙা আয়নায় মুখ দেখে দেখে চুলে বিলি কাটছে। মহিলাটা পান চিবোচ্ছে মনে হয়। সুখি মানুষেরাই কেবল এভাবে পান চিবোতে পারে। অসুখী মানুষেরা কখনো গাল লাল করে পান চিবোতে পারেনা।
শান্তা চোখ বুঝে তার বেডরুমে সেট করা অর্ডার করে বানানো পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা যায় আয়নাটায় নিজেকে এমন পান চিবানোর ভঙ্গিতে দেখার চেষ্টা করলো। নাহ! তার চোখে মুখে অন্তরার মার এই সুখের ভাবের লেশমাত্র নেই।
আতিক অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বসে আছে যেন সে এসব আলাপচারিতার কিছুই শুনছেনা কিন্তু আসলে সে সবই শুনছে গভীর মনযোগ দিয়ে।
অন্তরা মেয়েটা গুটি গুটি পায়ে ধুলা মাখা গায়ে ওদের একদম কাছাকাছি চলে এসেছে। এক হাতে করে একটা সস্তা প্লাস্টিকের গাড়ি টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছে। একেবারে কাছাকাছি এসে পড়তেই ছো মেরে অন্তরার মা ছোট্ট মেয়েটারে দূরে টেনে নিয়ে গেলো।
আতিক মনে মনে ফসিয়ার-অন্তরার মা দম্পতির কথা ভাবছে। ফসিয়ার একটু আগে কথা প্রসঙ্গে তার পেশার কথা বলেছিলো যে সে স্টেশনের পাশে একটা চায়ের দোকান চালাতো। করোনার চোটে সে ব্যবসা বহুদিন বন্ধ থাকায় খুব বিপাকে ছিলো সে তখন। এখন আস্তে আস্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও চায়ের দোকান আর দাঁড় করাতে পারেনি সে। স্টেশনে কুলিগিরি করে সংসার চালাচ্ছে আপাতত। অন্তরার মা এদিকে বাচ্চা আর ঘর সামলায়। অন্তরার মার স্ফীত পেট চোখে পড়ে যাওয়ায় আতিক বুঝতে পারছে ক’দিন বাদেই এই দম্পতির ঝুপড়ি ঘরের ছোট্ট জায়গাটিতে নতুন দখলদারের আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে।
আতিকের মাথায় কিছুতেই ঢুকছেনা এতটুকুন ঘরে কী করে এক হালি লোকের বাস্তু সংস্থান হবে! ফসিয়ারই বা কিভাবে সবার পেটের দানা জোটাবে? কিছুতেই আতিক কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারেনা।
– সংসার সামলান কিভাবে মানে খরচাপাতি কিভাবে মেটান?
ফসিয়ার এমন সহাস্যে হেসে উঠলো যে আতিকের হঠাৎ মনে হলো যেন সে দুনিয়ার সবচেয়ে বোকা প্রশ্নটা করে ফেলেছে!
না মানে, বাচ্চারও তো বেশ একটা খরচ আছে। আরেকটা বাচ্চা হলে ম্যানেজ করবেন কিভাবে?
– শোনেন ভাই, এত হিসেব কইরে কি জীবন চলে?
না তবুও!
– আবার তবুও কী?
এই যে জীবন, ইডার কোনো নিশ্চয়তা আছে কন? এই আছে এই নেই। আপনাগো মত শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা জীবনের এই মাথাত বসে জীবনের ঐ শ্যাষ মাথায় যাইয়্যে কী করবে সেই হিসেব করে কিন্তু দ্যাহা যায় জীবনের মাঝ মাথাত যাওয়ার আগেই স্টোক কইরে মরে। আপনিই কন এত হিসেবের লাভ কী হলো তাহলি?
ফসিয়ারের কথাটাকে অগ্রাহ্য করার মত ভালো যুক্তি খুঁজে পায়না আতিক।
– হ্যাঁ, তবুও হিসেব তো করা দরকার।
ভাইরে, হিসেব করতে করতেই যদি বেলা কাটায় ফেলেন তাহলি ঘরের পথ খুঁজে পাতি পাতি তো রাত্তিরির আন্ধার নামবোই। স্বাভাবিক।
হিমালয় সমান এক অপরাধবোধের চাপ আতিকের সমস্ত বুকটা চেপে ধরলো। প্রমোশন সময়মতো হয়নি, এক্সট্রা খরচ কিভাবে মেক-আপ করবে সেই চিন্তায় শান্তার প্রচন্ড চাপাচাপি, শত কান্নাকাটি সত্ত্বেও প্রথমবার কনসিভ করা বাচ্চাটাকে এবর্ট করিয়েছিলো সে। এই ঘটনার ফলে তাদের মধ্যে যে বিভেদের দেয়াল তৈরি হয়েছিলো তা এখনো দুজনের মাঝে ঠাই দাঁড়িয়ে।
শান্তা মেয়েটা মুখ মলিন করে অন্তরার দিকে চেয়ে আছে। আতিকের ভীষণ মায়া লেগে ওঠে শান্তার জন্য হঠাৎ করে।
স্টেশনে মাইকের ঘোষণা ভেসে আসছে। আন্তঃনগর সীমান্ত এক্সপ্রেস অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াবে। ফসিয়ার বাঁশ ছিলা বন্ধ করে গেঞ্জি ঝেড়ে গায়ে পরতে পরতে বললো
– আপনাগো গাড়ি (ট্রেন) আসতাছে বুঝি?
– হ্যাঁ, অনেক লেট করে ফেললো আজ। দেখি, আগাই সামনে তাহলে।
– দেহি, আমিও যাই ওদিকি। দু এট্টা খ্যাপ ধরা যায় কিনা।
ফসিয়ার হাটতে উদ্যত হয়েই থেমে যেয়ে আতিকের দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফিক করে হেসে দিয়ে বললো
– ভাই, ছোট মুখে একখান কথা কই আপনাগো?
স্মিত হাসি দিয়ে আতিক সম্মতির আভাস দিলো।
জীবনডারে মনে করবেন টেরেন লাইনি থাকা টেরেনের মত। টেরেনডারে নিজির গতিতিই চলতে দ্যান। গতি বাড়াতে যাইয়েন না। খালি মাঝে মদ্যি যদি মনে করেন যে ইঞ্জিন গরম হয়ে যাচ্ছে তালি আস্তে কইরে খালি একটু ব্রেক মাইরে জিড়ায় নেবেন। আর কিচ্ছু না।
ফসিয়ার ওদেরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গটগট করে হেটে চলে যায়।
ওরা দুজন লাগেজ টেনে হাঠতে শুরু করেছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে সীমান্ত এক্সপ্রেস প্লাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছে। ২-৩ মিনিট দাঁড়াবে।
ফসিয়ারের শেষ কথাগুলো আতিকের মাথায়, মগজে বাড়ি মারছে। বেসামালের মত কিছুক্ষণ হেটে সামনে এগিয়ে আসার পর পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে, শান্তা লাগেজ ধরে দাঁড়িয়ে আছে পুকুরের দিকে চেয়ে। ছোট্ট কোন একটা মাছের তাড়ায় পুকুরের অনেকখানি জায়গা জুড়ে পানিতে ঢেউয়ের আলোড়ন চলছে, কিছুসময় আগে আতিক পাথরের টুকরোটা ফেললে যেমনটা হয়েছিলো ঠিক তেমন।
আতিক শান্তার দিকে চেয়েই আছে। শান্তারও কি তাহলে ঠিক ওরই মত একই উপলব্ধি হচ্ছে?
সীমান্ত এক্সপ্রেস হুইসেল বাজানো শুরু করেছে…
লেখক- আরাফাত হিল্লোল
সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট
বিএসডি/এমএম