অধ্যাপক ডাঃ তাজুল ইসলাম
সুখি হতে কে না চায়? আসুন জেনে নেই সুখে থাকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সবাই তো সুখী হতে চায়
তবু….কেউ সুখী হয়
কেউ হয় না । কেন হয় না?
সবাই মৃত্যুর স্বাদ নেয়
অল্প কয়েকজন মাত্র জীবনের স্বাদ নেয়
———জালালউদ্দীন রুমি
যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়,জীবনে কি চান? নিশ্চিত বলা যায় সবাই বলবেন “সুখী” হতে চাই। আধ্ব্যাতিক পুরুষ রুমি যে বলেছেন সবাই জীবনের স্বাদ নিতে পারে না,কেন সেটা? প্রতিদিন জীবনের স্বাদ নিতে হবে, সুখী হতে হবে। কিছু নিয়ম প্রতিদিন মেনে চলতে হবে:
- নিজকে অনুমতি দিন (give yourself permission) : আমরা অনেক কিছুর জন্য অন্যদের কাছ থেকে পারমিশন চাই। কিন্তু নিজকে পারমিশন দিচ্ছেন তো? আপনি যা বা যেমন-তেমন থাকার পারমিশন? প্রাণ খুলে হাসতে; প্রয়োজন হলে কাদতে; দীপ্তময় ব্যর্থতাকে বরণ করতে; গুরুত্বহীন কাজ বা বোকার মতন কাজ করতে? বাস্তবতার চাপে সাময়িক ভাবে ভেঙ্গে পড়তে বা পতিত হতে এবং পরবর্তীতে দ্রত উঠে দাড়াতে, ঘুরে ফিরতে? যদি সন্তান বা প্রিয়জন উপরোক্ত পরিস্থিতিতে পড়ে তাকে পারমিশন দেন না?
তাহলে নিজকে নয় কেন? নিজকে এতো কম ভালোবাসেন? সবার থেকে ভিন্ন হওয়ার,অনন্য হওয়াকে গুরুত্ব দিন। (আমি তো দশকে ছাড়িয়ে রবীন্দ্র নাথের ভাষায় নিজকে একাদশে নিতে শ্লাঘা অনুভব করি)। নাকি অন্যদের উপহাস, সমালোচনা, এড়িয়ে চলা দেখে মুছড়ে পরেন? নিজের স্বপ্নপূরনে বহুদূর যেতে কি নিজকে অনুমতি দেন? নাকি অল্পতেই হাল ছেড়ে দেন? এ সব জরুরী প্রশ্ন।
সুখী হতে হলে, গর্বিত, তৃপ্ত হতে হলে, সম্মানিত গুরুত্বপূর্ন হতে হলে আপনাকে প্রতিনিয়ত নিজকে এ সব পারমিশন দিতে হবে। রাজী? অঙ্গীকার করুন নিজের কাছে, নিজকে ভালোবাসবেন গভীর ভাবে, নিজকে ওসব পারমিশন দেবেন উদার ভাবে
- নিজকে এতো সিরিয়াসলি নেবেন না (don’t take yourself so seriously) : আমরা যখন কারো সঙ্গে সহজ থাকি, ফুরফুরে মেজাজে থাকি, তখন তার সঙ্গে যে রকম সহজ ভাবে হ্যান্ডশ্যাক করি, নিজের হাতকে তেমন কোমল, নরম ভাবে ধরুন। নিজের ব্যক্তিত্ব, চরিত্রের গৌন দিক বা দুর্বলতা নিয়ে পরিহাস করুন, হাসি-তামাসা করুন। দেখবেন তখন অন্যরা আপনার দুর্বলতাকে ইঙ্গিত করে “ঘায়েল” করার ব্যর্থ চেস্টা করতে উৎসাহ বোধ করবে না। কেননা তারা জেনে গেছে আপনি এসবকে থোরাই কেয়ার করেন। যখন জীবনে কঠিন সময় আসবে,কাধ ঝাকিয়ে বলুন “ওহ তাই! সো ওয়াট?
মনে রাখবেন, কোন সমস্যাই এতো বড় নয়, এতো বিপর্য্যয়কর নয়, যেমনটি আপনার মন ভাবছে।
সুখী মানুষ বিশ্বাস করে যা কিছু মন্দ জীবনে ঘটুক না কেন, সেটির পরিবর্তন হবে। পৃথিবীতে কোন কিছুই অপরিবর্তনীয় নয়। যখনই বাধার মধ্যে পরবেন বা সঙ্কটে পরবেন তখনই স্বভাবগত ভাবে বলে উঠুন – সো ওয়াট? হু কেয়ারস? হোয়াই নট? হা হা হা হা…………………।।
- আপন মনে জাবর কাটবেন না (don’t self ruminate): সুখী মানুষ নিজদেরকে সমস্যার মধ্যে বা নিজের মধ্যে আটকে রাখে না, বেধে রাখে না। তারা সে সবকে অতিরিক্ত বিশ্লেষন করে না। তারা সমস্যার বাইরে চলে যান, নিজের কাজে ফিরে যান,হাস্য কৌতুক করার পরিকল্পনা করেন।
- নিজকে কারো সঙ্গে তুলনা করবেন না (don’t compare): তুলনা হচ্ছে ছোট খাট মৃত্যর সমান। যখনই কারো সঙ্গে তুলনা করবেন, নিজের সত্মাকে হত্যা করবেন। আমরা যখন তুলনা করি, নিজকে আহত করি। সুখী মানুষ জানে তারা অন্যদের চেয়ে বেশী ভালো বা বেশী মন্দ তা নয়। যে কোন ব্যক্তি কোন এক সময়”একটু ভালো” অবস্হায় থাকে, আবার অন্য সময় “একটু মন্দ” অবস্হায় থাকে। তাই কেউই আপনার চেয়ে অধিক সুখী বা অধিক সম্মানিত তা নয়, আবার তারা কম সুখী বা কম সম্মানিত তাও নয়। আপনার মনোযোগ থাকবে কিভাবে সর্বোত্তম থাকবেন। ব্যস, দ্যাটস অল।
- খাপ-খাইয়ে নিন (make adjustment) : যখন জীবন আপনার পথে চলে না,আপনার মন খারাপ থাকে, ম্যুড অফ থাকে– তখন আত্ম-সচেতন হন। পরিস্থিতির সঙ্গে অভিযোজন করে নিজের শক্তিমাত্তাকে ফাইন টিউন করে নিন। যদি দেখেন কিছু খেলে শরীর খারাপ হয়, কেন সেটি খাবেন?
যখন মনে হবে আটকে গেছেন, বিপর্যস্ত হয়ে পরেছেন– হাটুন; গতানুগতিক এর বাইরে কিছু করুন; কোন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করুন । যদি অতিরিক্ত উদ্বেগ, চাপে থাকেন ভালো ঘুম দিন, মেডিটেশন করুন, ইয়োগা করুন। নিজকে যে কোন পরিস্থিতির সঙ্গে ফাইন টিউন করে নিন।
- নিজের যত্ন নিন, অন্যকে সেবা দিন (be of service and know how to take care of yourself) : সুখী মানুষ যত পায়, তার চেয়ে বেশী ফেরত দেয়। তারা সব ব্যাপারেই শেয়ার করে। তারা ভলান্টিয়ার হয়,সমাজ সেবা করে,অন্যের সহায়তায় এগিয়ে যায়,কিন্তু বিনিময়ে কিছু প্রত্যাশা করে না। তবে একই সময়ে তারা নিজেদের যত্ন নিতেও ভুল করে না।
যখন শক্তি কমে আসে তখন শক্তি পুনরুদ্ধার করে, অবশেষটুকু নিঃশেষ করে দেন না। নিজের শারিরীক, মানসিক, আধ্বাতিক, আবেগে গত স্বাস্হ্যের প্রতি নজর রাখুন। নিজের যত্ন নিতে হবে যাতে অন্যেকে অধিক সেবা দিতে পারেন।
- বন্ধুত্বের মান বাড়ান (uplifting friendship): যখন আমরা কথা-বার্তায়,বন্ধুত্বে, সহযোগীতামূলক থাকি,ভালোবাসায় পূর্ন থাকি, আত্মিকও আবেগগতভাবে পরস্পরকে উচ্ছসিত করি, নৈতিক অনুপ্রেরনামূলক মানসিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায় তেমন প্রভাব রাখি- তখন আমরা আলোকিত সড়কে দ্রুত ধাবমান হতে পারি। যদি আপনি এমন কারো সঙ্গে সময় কাটান, যে পরবর্তীতে উচ্ছসিত, উৎকৃষ্ট, উৎফুল্ল মনে না হয়- তাহলে সে রকম বন্ধুর চেয়ে আরো উত্তম বন্ধু খুজুন।
বুঝতে চেষ্টা করুন কোন বন্ধুরা আপনার সুখকে বাড়িয়ে দেয়, সে সব বন্ধুত্বকে বেশী বেশী পরিপুষ্ট করুন।
- সুখী হওয়ার চেয়ে মনের শান্তি বজায় রাখতে বেশী মনোযোগী হন (be lees interested in being happy and more interested in your peace of mind): আমরা মনে করি সুখী থাকা মানে সব সময় “পরমানন্দে” থাকা। নিজের হতাশা, বিষন্নতাকে কাটিয়ে উঠার জন্য আমরা অবশ্যই সম্ভব সর্বোচ্চ ভালো থাকার চেষ্টা করবো। কিন্তু মনে রাখবেন যত উচুতেই থাকুন না কেন, আপনাকে এক সময় নীচে নেমে আসতে হবে। এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। (রোগ কাহিনীতে, ম্যানিয়া রোগের উল্লেখ করে বলেছিলাম, সব সময় সুখে থাকা প্রকৃতি বিরুদ্ধ রীতি। এটি একটি গুরুতর একটি মানসিক ব্যাধি) এর চেয়ে বরং শান্তিপূর্ন,সহজ,স্বাচ্ছন্দ
্য জীবন-যাপনে অধিক মনোযোগী হোন। যখন আপনি শান্তিতে থাকবেন তখন উচ্চ-নীচের মধ্যে একটি ভারসাম্য থাকে। এবং তখন স্হায়ী সুখ শান্তিতে থাকার সম্ভাবনা ও বেড়ে যায়।
- নিজের সেন্স গুলো ব্যবহার করুন (use your senses): কথায় আছে সাধারনই অসাধারন (ordinary is extraordinary) : সুখী মানুষ জানে কি ভাবে প্রতিদিনের সাধারন,সহজ বিষয় থেকে সুখ পেতে হয়। এগুলোর বেশীর ভাগই আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের (সেন্স) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। জীবনের ও চারপাশের সব দিকে নজর রাখুন। দেখবেন চারপাশে প্রতি দিন সুখী হওয়ার,মুগ্ধ হওয়ার অনেক কিছুই আছে। শুধু দরকার দেখার মতন চোখ, শোনার মতন কান, ঘ্রান নেওয়ার মতন নাক, স্বাদ নেওয়ার মতন জিহ্বা, স্পর্শ নেওয়ার মতন চর্ম।
- কিছু উদাহরন:
১. শীত কালে চায়ের কাপে হাত দিয়ে কি উষ্ণতা টের পান ?
২. ঘাড় চকলেটের প্রবাহ যখন জিহবা দিয়ে গড়িয়ে পরে তখন কি সে স্বাদ পূর্নভাবে অনুভব করেন? (আমি যে দিন কোন খাবারে ভালো স্বাদ পাই, তখন সঙ্গে সঙ্গে পানি খাই না। কিছুক্ষন সে অমৃত স্বাদ উপভোগ করতে থাকি)
৩. সাইকেল চালানোর সময় ড্যান্স মিউজিকের আন্দোলন টের পান ?
৪. পথে ঘাটে কোন আগন্তুকের হাসি মুখ দেখে মন আনন্দে ভরে উঠে ? ( আমি চাদপুর প্রাকটিস করতে লন্চে আসা যাওয়ার সময়টিতে, বিশেষ করে সন্ধার সময়টি বাইরের নান্দনিক দৃশ্য দেখে আপ্লুত হই, বিদেশ গেলেও হেটে ঘুরার চেষ্টা করি। চারপাশের জন জীবনও প্রকৃতিকে অন্তরঙ্গ নিবিড় ভাবে দেখতে চাই) বড় বড় অর্জন হলেই সুখী হবো সে চিন্তা করলে বরং হতাশ হতে পারেন। বরং প্রতিদিনের চারপাশ থেকে, নিজের সাদা-মাঠা জীবন থেকে সুখের খনি খুঁজে নিন।
- অন্তরঙ্গ সম্পর্ককে সব কিছুর আধার বানাবেন না: সুখী মানুষ জানে যারা তাদের ঘনিষ্ট মানুষ, তারা বাড়তি কিছু, তারা সম্পূর্নতার অংশ নয়: তারা জীবনকে পূর্নভাবে যাপন করে, যাতে দিনের শেষে তাদের এত অধিক থাকে যে, তারা শেয়ার করতে পারে। আপনার মন, ম্যুড ভালো করার জন্য, আপনার ক্ষত মোছনের জন্য, আপনার শুন্যতা পূরনের জন্য- পার্টনারের উপর নির্ভর করবেন না। উল্টোটিও সত্য। সহযোগীতা হচ্ছে সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ন অংশ। সঙ্গী সাথীদের সাথে আমরা দুঃসময়ে মমতা করুনা, দয়া দিয়ে সময় কাটাই। আবার সুসময়ে তাদের সঙ্গে আনন্দ উল্লাসে জীবন কাটাই। তথাপি আমরা মূলত নিজেদের সুখের জন্য নিজেরা দায়ী। আমরা চেষ্টা করবো তাদের জন্য একটু জায়গা ছেড়ে দিতে যাতে, তারা নিজেদের সুখ নিজেরা খুজে নিতে পারে।
আপনার মন, ম্যুড ভালো করার জন্য, আপনার ক্ষত মোছনের জন্য, আপনার শুন্যতা পূরনের জন্য- পার্টনারের উপর নির্ভর করবেন না।
লেখক: অধ্যাপক ডাঃ তাজুল ইসলাম
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট
বিএসডি/ডাঃ তাজুল/মুছা মল্লিক