নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশে এসএসসি পর্যন্তই শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার ৪৫ শতাংশ। প্রথম শ্রেণিতে যে সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, তার মধ্যে মাত্র ৫৫ ভাগ শিক্ষার্থী এসএসসি পাশ করে। বাকিরা দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে লেখাপড়ার কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়ে। ১১ বছরের সরকারি তথ্য পর্যালোচনা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বর্তমান সময় কে বলেন, আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল যে, বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী করোনাকালে লেখাপড়া ছেড়ে দেবে। এর ফলে শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু বেড়ে যেতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত করোনার কারণে ঝরে পড়ার প্রকৃত চিত্র আনুষ্ঠানিক সমীক্ষায় বের হয়নি, তবে যে তথ্য আসছে, তা ভয়াবহ আর উদ্বেগজনকই বলতে হবে।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই হয়তো শিশুশ্রমে ভিড়ে গেছে কিংবা বিয়ে হয়েছে। লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই যদি ছাত্রী হয়ে থাকে, তবে তা উদ্বেগজনক খবর। এসব ছাত্রছাত্রীকে স্কুলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আর এই উদ্যোগের আগে নিরপেক্ষ সমীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ফিরিয়ে আনতে না পারলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের যে অর্জন এবং সুনাম আছে, তা নষ্ট হবে।
শিক্ষার সার্বিক চিত্র নিয়ে প্রতিবছর দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়ে থাকে। এর একটি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) ‘বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারি’ নামে প্রকাশ করে। আরেকটি ‘বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান’ নামে প্রকাশ করে ব্যানবেইস (বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো)। ডিপিই-এর ২০১০ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রথম শ্রেণিতে ওই বছর ৩০ লাখ ৪৬ হাজার ৫১৩ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ২০২০ সালে নিয়মিত এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থী ছিল ১৬ লাখ ৮১ হাজার ৬৮৮ জন। অর্থাৎ, ১০০ জনের মধ্যে ৫৫ দশমিক ২০ জন পরীক্ষা দিয়েছে। আবার এসব শিক্ষার্থীর সবাই ওই বছর পাশ করতে পারেনি। এই সংখ্যা ধরা হলে শিক্ষা শেষ করতে না পারা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে।
উল্লিখিত দুই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০১০ সালে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা ২০১৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছে। এই স্তরে তখন পরীক্ষার্থী ছিল ২৯ লাখ ৪৯ হাজার ৭৫৫ জন। তাদের মধ্যে পাশ করে ২৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭৮১ জন। এই ব্যাচটিই ২০১৭ সালে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা দেয়। ওইবছর পরীক্ষার্থী ছিল ২৪ লাখ ৮২ হাজার ৩৪২ জন। আর পাশ করেছিল ২০ লাখ ১৮ হাজার ২৭১ জন।
এদিকে করোনাকালে ঝরে পড়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা গেছে ছাত্রীদের মধ্যে। ২০২১ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ১৪ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। এতে ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মোট ২২ লাখ ২৭ হাজার ১১৩ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। তাদের মধ্যে নয়টি বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, নিয়মিত পরীক্ষার্থী ছিল ১৬ লাখ ৭০ হাজার ৩৮০ জন। আর দুবছর আগে এসব বোর্ডে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১৯ লাখ ৪৮ হাজার ৫৬ জন। বাকি ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮৭৬ জনের হদিস নেই। ১১টি বোর্ডের তথ্য যুক্ত করা হলে এই সংখ্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ৭২ শতাংশই ছাত্রী। করোনা শুরু হওয়ার সময়ে এসব শিক্ষার্থী দশম শ্রেণিতে ছিল।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৯টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝরে পড়েছে মাদ্রাসায়। মাদ্রাসা বোর্ডে ৩ লাখ ২১ হাজার ৭৭৯ জন রেজিস্ট্রেশন করলেও পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৫৬০ জন। বাদ পড়ে যায় ৭০ হাজার ২১৯ জন। এটা শতকরা হিসাবে ২১ দশমিক ৮২। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে কুমিল্লায় ২ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯২ জন নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করলেও অংশ নেয় ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪ জন। ৩৫ হাজার ৪৯৮ জন বা ১৫ দশমিক ১৪ শতাংশ ঝরে পড়ে।
এদিকে এবার এইচএসসি ও সমমানে মোট নিয়মিত পরীক্ষার্থী ছিল ১২ লাখ ৮৭ হাজার ১৬২ জন। দুবছর আগে তাদের সঙ্গে মোট নিবন্ধিত হয়েছিল ১৫ লাখ ৭৫ হাজার ৬৬১ জন। অর্থাৎ পরীক্ষার আগেই ২ লাখ ৮৮ হাজার ৪৯৯ জন ঝরে পড়ে, যা শতকরা ১৮ দশমিক ৩০ ভাগ। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ১ লাখ ৫৭ হাজার ২০২ জন; যার শতকরা হার ৫৪ দশমিক ৪৮।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১ সালের এইচএসসি শিক্ষার্থীরা ২০১৯ সালে এসএসসি এবং ২০১৬ সালে জেএসসি পাশ করেছে। ২০১৯ সালে এসএসসি পাশ করেছিল ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৬৫ জন। অর্থাৎ এইচএসসি পর্যন্ত ৪ লাখ ৬২ হাজার ৩ জন ঝরে গেছে, যার হার ২৬ শতাংশ ৪১ শতাংশ। আর জেএসসিতে (২০১৬ সালে) এই ব্যাচে পাশ করা শিক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ৯৮ হাজার ৮৪ জন।
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। তাদেরকে প্রণোদনার অংশ হিসাবে উপবৃত্তি দেওয়া হয়। কিন্তু এটা পাওয়ার অপরিহার্য শর্ত তাকে ‘অবিবাহিত’ থাকতে হবে। কিন্তু যত লাখ ছাত্রী পরীক্ষায় বসছে না, তাদের মধ্যে যে ক’জনের বিয়ে হয়েছে, তাদেরকে যদি স্কুলে দেখতে চাই তাহলে ‘অবিবাহিত’ থাকার শর্ত তুলে দিতে হবে। নইলে তারা আগ্রহী হবে না।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিচালক অধ্যাপক আমির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, করোনাকালে শিখন ঘাটতি আর ঝরে পড়ার হার নিরূপণে আলাদা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জানুয়ারিতে এই কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কার্যক্রম স্থগিত আছে। তবে স্কুল খোলার পর তথ্য আসছে। ইতোমধ্যে ৭ হাজার প্রতিষ্ঠানের তথ্য এসেছে। সব তথ্য এলে ঝরে পড়ার চিত্র পাওয়া যাবে।
একই সংস্থার মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, করোনাকালে কিছু বাস্তব কারণে শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। এখন তারা কোথায় আছে, সেটা যেমন চিহ্নিত হওয়া দরকার তেমনই তাদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনাও জরুরি। সমীক্ষা শেষে এটি অবশ্যই আলোচনায় আসবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আমিনুল ইসলাম খান যুগান্তরকে বলেন, ঝরে পড়া আর শিক্ষার্থীর লেখাপড়া সমাপনের চিত্র বের করা আমাদের নিয়মিত কাজ। কিন্তু করোনাকালে এর বিশেষ কোনো প্রভাব আছে কি না, থাকলে বিশেষ কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তা অবশ্যই বিবেচনা জরুরি। মাত্র স্কুল খুলল। এ নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বিএসডি/ এফএস