সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশি তরুণীকে বিবস্ত্র করে কয়েকজন যুবকের যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরালের ঘটনায় আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রের মূলহোতা ঝিনাইদহের আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফিসহ চক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গ্রেপ্তার হওয়া অন্য সদস্যরা হলেন—যশোরের সাহিদা ওরফে ম্যাডাম সাহিদা, ইসমাইল সরদার ও আবদুর রহমান শেখ।
গত সোমবার রাতে ঝিনাইদহ ও যশোরের অভয়নগর ও বেনাপোল এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। প্রতারণার ফাঁদে ফেলে ভারতে নারী পাচার চক্রের এ সদস্যরা বাংলাদেশে গড়ে তুলেছিলেন ভয়ঙ্কর এক সংঘবদ্ধ চক্র। দেশি-বিদেশি ৫০ জন এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। যারা পাচার করা নারীদের বাধ্য করতেন যৌন ব্যবসায়।
মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ভারতে নারী পাচার চক্রের মূল হোতা আশরাফুল ইসলাম আট বছর ধরে ভারতে যাতায়াত করেন। আর পাঁচ বছর ধরে ভারতে নারী পাচার করে আসছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে আশরাফুল ইসলাম স্বীকার করেন, তিনি গত পাঁচ বছরে পাঁচ শতাধিক নারীকে বিভিন্নভাবে ভারতে পাচার করেছেন। টিকটকে মডেল হওয়ার কাজে ভারতে যাওয়ার প্রলোভন দেখালেও পাচার হওয়া নারীদের ভারতে নিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক মাদক সেবন করিয়ে এবং নাচ শিখিয়ে পতিতাবৃত্তির কাজে বাধ্য করানো হতো। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা এ ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। প্রতারণার ফাঁদ পেতে তরুণীদের পাশের দেশ ভারতে পাচার করত এই চক্র।
তিনি আরও জানান, আশরাফুল আলমের সহযোগী টিকটক হৃদয় বাবু অনলাইনে সোশ্যাল মিডিয়ায় তরুণীদের মাধ্যমে একটি গ্রুপ তৈরি করেন। তরুণীদের মডেল বানানোর প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে তাদের প্রথমে আকর্ষণ করা হতো। পরে তাদের বিভিন্ন সুপার মার্কেট ও পাশের দেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে আশরাফুলের সহযোগিতায় বিদেশে পাচার করত ওই চক্র। টিকটক ভিডিও তৈরির ফাদে ফেলে তরুণীদের ভারতে পাচার করা হচ্ছে। সম্প্রতি ভারতে কয়েকজন মিলে এক বাংলাদেশি তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ভিডিও অনলাইনে ভাইরাল হওয়ার পর বিষয়টির অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।
ওই তরুণীকে নির্যাতনের ঘটনায় রিফাদুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় নামে ঢাকার মগবাজার এলাকার এক বাসিন্দাকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। এই রিফাদুলই মেয়েটিকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর কথা বলে বছরখানেক আগে ভারতে নিয়ে যান বলে তার পরিবার জানায়। এ ঘটনায় রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা হয়।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, বেশ কয়েকটি ধাপে নারী পাচারের কাজ করতো চক্রটি। ভিকটিমদের বৈধ বা অবৈধ উভয় পথেই সীমান্ত অতিক্রম করানো হতো। তারা কয়েকটি ধাপে পাচার করতো। প্রথমত, ভিকটিমদের তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সীমান্তবর্তী জেলা, যেমন- যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ নিয়ে আসতো। এরপর ভিকটিমকে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন সেফ হাউজে নিয়ে রাখা হতো। সেখান থেকে সুবিধাজনক সময়ে লাইনম্যানের মাধ্যমে অরক্ষিত এলাকা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করানো হতো। পার্শ্ববর্তী দেশের এজেন্টরা তাদের সীমান্ত নিকটবর্তী সেফ হাউজে রাখতো। সুবিধাজনক সময়ে কলকাতার সেফ হাউজে পাঠানো হতো। কলকাতা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বেঙ্গালুরু পাঠানো হতো তাদের। বেঙ্গালুরু পৌঁছানোর পর গ্রেপ্তারকৃত বস রাফি তাদের বিভিন্ন সেফ হাউজে রাখতো। এরপর ব্ল্যাকমেইল ও মাদকাসক্তে অভ্যস্ত ও অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে যৌন ব্যবসায় বাধ্য করা হতো। সেফ হাউজগুলো থেকে তাদের ১০/১৫ দিনের জন্য বিভিন্ন খদ্দেরের কাছে পাঠানো হতো। এক্ষেত্রে পরিবহন ও খদ্দেরের নির্ধারিত স্থানে অবস্থানের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা নেওয়া হতো। রাফি একসময় এ ধরনের পরিবহনের কাজে নিয়োজিত ছিল। রাফি তামিল ভাষা রপ্ত করেছিল। ফলে এ ক্ষেত্রে ভাষাগত দক্ষতা ব্যাপক ভূমিকা রাখে। একপর্যায়ে সে লিডার হয়ে যায়। পার্শ্ববর্তী দেশের এজেন্ট তাকে খদ্দেরপ্রতি ১০-১৫ হাজার টাকা কমিশন দিতো।
বস রাফির শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি। ৮ বছর আগে থেকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে তার যাতায়াত শুরু হয়। সে সেখানে ট্যাক্সি ড্রাইভার, রিসোর্ট কর্মচারী হিসেবে ও কাপড়ের ব্যবসা করতো। ৫ বছর ধরে সে নারী পাচারে জড়িত। দুই বছর আগে টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে তার পরিচয়। টিকটক হৃদয়ের মাধ্যমে অর্ধশতাধিক তরুণীকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করেছে বস রাফি। টিকটক হৃদয় ছাড়াও তার অন্যান্য এজেন্ট রয়েছে। সম্প্রতি ভারতে এক তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়। ওই তরুণীকে ভারতে পাচার করে টিকটক হৃদয়। বস রাফি তাকে গত বছরের অক্টোবরে বেঙ্গালুরে নিয়ে সবুজের বাড়ির সেফ হাউজে রাখে। সেখানেই ভিডিওটি ধারণ করা হয় বলে জানা যায়। বেঙ্গালুরে বস রাফির বেশ কয়েকটি সেফ হাউজ রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে তার সেফ হাউজ রয়েছে। এরমধ্যে ম্যাডাম সাহিদার সেফ হাউজ অন্যতম।
বস রাফির অন্যতম নারী সহযোগী ম্যাডাম সাহিদা। তার তিনবার বিয়ে হয়েছিল। সে এবং তার দুই মেয়ে সোনিয়া ও তানিয়া বর্ণিত পাচার চক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাবে জড়িত। সোনিয়া ও তানিয়া বর্তমানে বেঙ্গালুরে অবস্থান করছে বলে গ্রেফতারকৃত সাহিদা জানায়। ভাইরালকৃত ভিডিওতে তানিয়াকে সহযোগী হিসেবে দেখা গিয়েছে। সাহিদা বাংলাদেশ এলাকায় একটি সেফ হাউজ পরিচালনা করছে। সে এই ব্যবসায় ১০ বছর ধরে জড়িত। এছাড়া গ্রেফতারকৃত ইসমাইল ও আব্দুর রহমান শেখ বস রাফির বিশেষ সহযোগী হিসেবে পাচার তদারকি করে থাকে। তারাও নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত।
জানা গেছে, আশরাফুল মণ্ডল ওরফে রাফি ভারতের কয়েকটি শহরে নিজেকে ভারতীয় ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেন। ২৯ বছরের এই যুবক ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতে নারী পাচারে জড়িত। তার বাবার নাম আইন উদ্দিন মণ্ডল। গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানার পশ্চিমপাড়া। আটক আব্দুর রহমান শেখ ভারতে আরমান নামে পরিচিত। টিকটক হৃদয় এবং রাফি চক্রের অন্যতম সদস্য রহমান শেখের বয়স মাত্র ২৫ বছর। তার বাবার নাম জামাল শেখ। গ্রামের বাড়ি যশোরের বেনাপোল থানার পোড়াবাড়ি।
প্রসঙ্গত, ভারতের বেঙ্গালুরুতে একটি পাচারকারী চক্রের হাতে বাংলাদেশি এক তরুণীর যৌন নিপীড়নের ভিডিও ফাঁসের পর তোলপাড় শুরু হয়। একপর্যায়ে নিপীড়ক ৩ যুবক এবং ১ কিশোরীকে গ্রেপ্তার এবং নির্যাতিত তরুণীকে গ্রেপ্তার করে ভারতীয় পুলিশ। এদের সবাই বাংলাদেশি। ঘটনার পর রিফাদুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় নামের এক যুবকের নাম বেরিয়ে আসে। যিনি টিকটক অ্যাপসে ভিডিও বানানোর আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী পাচার করে আসছিলেন। টিকটক হৃদয় ঢাকার মগবাজারের বাসিন্দা হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেন নির্যাতনের শিকার তরুণীর বাবা।
সূত্র বলছে, টিকটক হৃদয়ের নারী পাচার চক্রের মূল হোতা আশরাফুল মণ্ডল ওরফে রাফি। তিনি একাই এখন পর্যন্ত ৫ শতাধিক তরুণীকে ভারতের পতিতালয়ে পাচার করেন। বছরের বেশিরভাগ সময় তিনি ভারতেই অবস্থান করেন। রাফির হাতে ভারতের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত জাল কাগজপত্র রয়েছে। ভারতীয় পুলিশের হাতে আসা একটি ভিডিওতে রাফিকে কোকেন সেবন করতে দেখা যায়। এর সূত্র ধরে তাকে চিহ্নিত করা হয়। তিনি ভারতে পাচারের শিকার তরুণীদের কোকেনসহ বিভিন্ন মাদক সেবনে বাধ্য করেন। কারণ উচ্চমাত্রায় মাদক সেবনের পর পাচারের শিকার নারীদের অনেকেই বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য অবস্থায় দিনের পর দিন তারা মুখ বুজে পাশবিক নির্যাতন সহ্য করে যান। একপর্যায়ে তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।