'জিলানী সিন্ডিকেটে' পঙ্গু হচ্ছে জনপ্রশাসন

ঐতিহাসিক ৫ আগস্টের পর নতুন বাংলাদেশে জনপ্রশাসন সংস্কারকে সরকার সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ শুরু করে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সেই উদ্যোগ বারবার ধাক্কা খাচ্ছে। দীর্ঘদিন বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ন্যায্য পদায়ন না হওয়া, আওয়ামী সুবিধাভোগীদের আবারও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে পাঠানো এবং বিতর্কিতদের মাঠপ্রশাসনে ঠেলে দেওয়াই যেন জনপ্রশাসনের রুটিন চিত্রে পরিণত হয়েছে।
এই ধারাবাহিক অচলাবস্থার সুযোগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ভেতরে গড়ে ওঠে শক্তিশালী একটি গোপন সিন্ডিকেট—যা প্রশাসনজুড়ে ‘জিলানী সিন্ডিকেট’ নামে পরিচিত। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, কাঠামোগত দুর্বলতা, শীর্ষ পর্যায়ের নীরবতা এবং প্রভাব বিস্তারের সুযোগে এই সিন্ডিকেট এখন জনপ্রশাসনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থান করছে।
যেভাবে সিন্ডিকেটের উত্থান
সূত্রের দাবি—৫ আগস্টের পর জেলা প্রশাসক নিয়োগে বিপুল অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠা সাবেক সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমানের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এই সিন্ডিকেট আরও ভয়াবহভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় পদোন্নতি–পদায়নে প্রতিষ্ঠিত হয় সীমাহীন নৈরাজ্য। এই সিন্ডিকেটের নেটওয়ার্ক ধরে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলোতে ধারাবাহিকভাবে পদায়ন করা হয়েছে আওয়ামী সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের। অন্যদিকে বহু বছর বঞ্চিত থাকা সত্ত্বেও অনেক কর্মকর্তা হয়েছেন আরও বেশি প্রশাসনিক রোষানলের শিকার।
সাবেক সিনিয়র সচিবের বিদায়ের পরও তাঁর ছড়িয়ে দেওয়া শক্তিশালী কাঠামো এখনো নিয়ন্ত্রণ করছে গোটা জনপ্রশাসনকে। এই সিন্ডিকেটের প্রভাবেই সর্বশেষ নির্বাচনকালীন ডিসিদের মাঠে পাঠানো হয়। অবশ্য বিতর্ক তৈরি হওয়ায় পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বাধ্য হয়েছে কয়েকজন আওয়ামী সুবিধাভোগী কর্মকর্তাকে মাঠ থেকে তুলে আনতে। তবে এখনো বেশ কিছু জেলায় ঘাপটি মেরে বসে আছেন খোদ আওয়ামী সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা। তাঁদের হাতেই দেওয়া হচ্ছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দায়িত্ব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের বিভিন্ন জেলায় এখনো রাজনৈতিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্তদের হাতে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া প্রশাসনের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সরাসরি ঝুঁকি। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রথমেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে এপিডি উইং নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে এবং মাঠ থেকে আওয়ামী সুবিধাভোগীদের সরাতে হবে।
অভিযোগ: বাণিজ্য, তদবির আর প্রভাব বিস্তার
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এ মন্ত্রণালয় কয়েকজন কর্মকর্তার বাপ-দাদার সম্পত্তি হয়ে গেছে। এপিডি উইংকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি টাকার বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতির বাণিজ্য হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে জনপ্রশাসন চলতে পারে না। এ অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন আনাই এখন জরুরি দায়িত্ব হয়ে পড়েছে।”
এদিকে এপিডি উইংকে ঘিরে এত ব্যাপক কারসাজির কারণে জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্সও বারবার সরকারকে সতর্ক করেছে। তাঁদের অভিযোগ—এই উইং নিয়ন্ত্রণ করছেন যুগ্মসচিব মিয়া আশরাফ রেজা ফরিদী। সংগঠনের দাবি, ফরিদীর নেতৃত্বে প্রশাসনে গোষ্ঠীগত প্রভাব তৈরি হয়েছে, যার ফলে পদায়ন, বদলি ও দায়িত্ব বণ্টনে যোগ্যতার বদলে নিজেদের গ্রুপকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত গুরুত্ব পাচ্ছে। সংগঠনটি বলছে—এ সিন্ডিকেটে তাঁর অধীনস্ত কিছু কর্মকর্তা রয়েছে। তাঁরা সরাসরি এই সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য। একজন সদস্য নানা অনিয়মে কিছুদিন জনপ্রশাসনের বাইরে থাকলেও নতুন করে তিনিও এই গুরুত্বপূর্ণ উইংয়ে প্রবেশ করেছেন। ৩১তম ব্যাচের ওই কর্মকর্তার ফলে এই সিন্ডিকেট আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সূত্র বলছে—তাঁর হাত ধরেই নিয়ন্ত্রণ হতো মাঠ পর্যায়ের বদলি–পদায়ন ও পদোন্নতি।
এপিডি উইং ঘিরে গুরুতর অভিযোগের চিত্র
হাতে আসা সংশ্লিষ্ট নথিতে দেখা যায়—এই উইং থেকে দীর্ঘদিন ধরে একটি বিশেষ দলীয় প্রভাবনির্ভর কর্মকর্তা বাছাই করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে এবং নেটওয়ার্ককে শক্ত করা হয়েছে। সিন্ডিকেটের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য থেকে তাঁর নিকটাত্মীয় ও ঘনিষ্ঠরা প্রশাসনের নানা শাখায় অস্বাভাবিক সুবিধা পেয়েছেন—কেউ গুরুত্বপূর্ণ শাখায় পদায়ন, কেউ শাস্তিমূলক বদলি থেকে রক্ষা, কেউ দ্রুত পুনর্বহাল হয়েছেন। স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে দক্ষতার চেয়ে রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার ভিত্তিতে কর্মকর্তা বসানোর অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
এছাড়া আইন–শৃঙ্খলাসংশ্লিষ্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা ছাড়াই ৯ জন ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যা সিনিয়র–জুনিয়র প্রশাসনে তীব্র অস্বস্তি তৈরি করেছে। অভিযোগ আছে—তিনি বিভিন্ন সংস্থা, বোর্ড, দপ্তরের দায়িত্ব বণ্টনেও সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন, যা প্রশাসনের স্বাভাবিক শৃঙ্খলাকে বিপর্যস্ত করেছে।
এখনো বহাল আওয়ামী সুবিধাভোগী আমলারা
অনুসন্ধানে দেখা গেছে—এ উইং থেকে দেশের বেশ কিছু জেলাকে আওয়ামী পুনর্বাসনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং সেখানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের।
১৩ নভেম্বর ঢাকার জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান বিসিএস ২৭তম ব্যাচের উপসচিব মো. রেজাউল করিম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে ২০০৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগে স্নাতক শেষ করেন তিনি। ২০০৮ সালে চাকরিতে যোগ দেওয়া এই কর্মকর্তা ২০১৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত এক বছর এক মাস সাত দিন সরাসরি মাঠ প্রশাসনের বাইরে ছিলেন। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের ২৯ মে পর্যন্ত পাঁচ বছর এক মাস আঠারো দিন শিক্ষা ছুটিতে ছিলেন। কর্মজীবনে প্রায় ছয় বছরের বেশি সময় তিনি সরাসরি মাঠপ্রশাসনের বাইরে থেকেও ঢাকার জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় প্রশাসনের ভেতরে–বাইরে নানা আলোচনা ও সমালোচনা দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে ঢাকার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলায় মাঠপ্রশাসন থেকে দীর্ঘদিন বাইরে থাকা কোনো কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া অনুচিত। নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের উচিত ছিল অপেক্ষাকৃত অভিজ্ঞ, দক্ষ ও মাঠপ্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের পদায়ন করা।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে সম্প্রতি পদায়ন পাওয়া মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিয়াকেও ঘিরে উঠেছে বিতর্ক। বিসিএস ২৫তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা পূর্ববর্তী সরকারের ক্ষমতাধর চার সচিবের একান্ত সচিব (পিএস) হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। অভিযোগ রয়েছে—এই সময়ে টেন্ডারপ্রক্রিয়ায় অবৈধ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বিপুল অর্থ উপার্জন করেছেন তিনি। তাঁর মতো বিতর্কিত ও সুবিধাভোগী কর্মকর্তাকে চট্টগ্রামের মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলায় দায়িত্ব দেওয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে—এই কর্মকর্তার স্ত্রীর মূল বাড়ি চট্টগ্রামে, কিন্তু বিষয়টি উল্লেখ না করে তিনিই স্ত্রীর জেলাতেই ডিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০২ সালে ইংরেজি বিভাগে তৃতীয় বিভাগ পেয়ে স্নাতক শেষ করেন সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মো. রায়হান কবির। ২০০৩ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে স্নাতকোত্তর শেষ করেন তিনি। ২০১১ সালের আগস্টে ইকনোমিক ক্যাডারে যোগ দেওয়া এই কর্মকর্তা মাঠপ্রশাসনে উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা ছাড়াই জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে।
সম্প্রতি নড়াইলের জেলা প্রশাসক থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা শারমিন আক্তার জাহানকে। উপসচিব পদে পদোন্নতির পরই তাঁর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর মাজারে ফুল দিয়ে আওয়ামী সরকারের পক্ষে শপথ নেন কয়েকজন কর্মকর্তা। নড়াইলে দায়িত্ব পালনকালে নানা আর্থিক অনিয়ম ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা অন্তর্ভুক্তির ঘটনায় সমালোচিত হলেও তিনিই পরপর দুই জেলায় ডিসির দায়িত্ব পেয়েছেন। তাঁর মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ না করা, ক্ষমতাধর আমলাদের ঘনিষ্ঠতা এবং পরপর পদায়নে মন্ত্রণালয়ের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বহু কর্মকর্তা।
প্রশাসনের মর্যাদা ও পেশাদারিত্ব ধ্বংস হচ্ছে—বিশেষজ্ঞদের মত
জনপ্রশাসনের সাম্প্রতিক অস্থিরতা প্রসঙ্গে সাবেক সচিব ও জনপ্রশাসন বিশ্লেষক আনোয়ার ফারুক বলেন, “প্রশাসনে বহু দিন ধরেই গোপন গোষ্ঠী বা অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কের প্রভাব ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে বদলি–পদায়ন পুরোপুরি একটি প্রভাবশালী চক্রের হাতে চলে গেছে, তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এর ফলে দক্ষতার ভিত্তিতে পরিকল্পনা গ্রহণ, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন এবং মাঠপর্যায়ে সুশাসন নিশ্চিত—সবই ব্যাহত হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় রাষ্ট্র পরিচালনার মূল কেন্দ্র। এখানে যদি অসৎ তদবিরকারী বা সংগঠিত সিন্ডিকেট প্রবেশ করে, তাহলে সরকারি কাঠামো ভেঙে পড়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এখন যে অভিযোগগুলো উঠেছে—স্বজনপ্রীতি, দলীয় প্রভাব, নিজেদের গ্রুপের সুবিধা বণ্টন—এসবই প্রশাসনের মর্যাদা ও পেশাদারিত্বকে ধ্বংস করছে।”
প্রশাসনিক আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার জাহিদ রহমান বলেন, “জনপ্রশাসনের সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়ায় যদি গোষ্ঠীগত প্রভাব ঢুকে পড়ে, তবে নীতিনিষ্ঠ ও যোগ্যতা-ভিত্তিক প্রশাসন স্থাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক অভিযোগগুলো ইঙ্গিত দেয়—দায়িত্ব বণ্টনে স্বচ্ছতার ঘাটতি বাড়ছে। দ্রুত স্বাধীন তদন্ত ও কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না।”
এএন










