“রোগ দিছে আল্লাহ, রোগ নেবে আল্লাহ”—এমন ভাবনা ইসলাম সমর্থন করে না বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট ইসলামি ব্যক্তিত্ব ও ধর্মীয় আলোচক অধ্যক্ষ মাওলানা মোশতাক ফয়েজী। তিনি বলেন, “রাসূল (সা.) তাকদির মানতেন, কিন্তু তাদবিরে—অর্থাৎ চিকিৎসা ও প্রতিকারমূলক উদ্যোগে সবসময় জোর দিতেন।”
আজ (মঙ্গলবার) ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজের অডিটোরিয়ামে আয়োজিত সীরাতুন্নবী (সা.) আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ও চিকিৎসকরা উপস্থিত ছিলেন।
চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে নবীজির দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ ফয়েজী বলেন, নবী করিম (সা.) কখনো মানুষকে ভাগ্যের দোহাই দিয়ে চিকিৎসা থেকে নিরুৎসাহিত করেননি। বরং তিনি চিকিৎসাকে উৎসাহিত করেছেন এবং তার সময়কার হেকিমদের রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।
তিনি বলেন, “রাসূল (সা.) নিজে কখনো ভরপেট খেতেন না—তিন ভাগের এক ভাগ খাবার, এক ভাগ পানি, আর এক ভাগ খালি রাখতেন। পরিমিত খাদ্যাভ্যাস, কায়িক পরিশ্রম ও পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন ছিল তার অনুসারীদের নিয়মিত চর্চা।”
ফয়েজী জানান, একবার এক বিদেশি চিকিৎসক মদিনায় এসে মুসলমানদের চিকিৎসা করতে না পেয়ে ফিরে গিয়েছিলেন, কারণ তাদের মধ্যে তেমন কোনো রোগীই ছিল না। নবীজির ব্যক্তিগত জীবনও ছিল শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্যের অনন্য উদাহরণ।
তিনি আরও বলেন, নবীজির দোয়া ও লালাও শিফা হিসেবে কাজ করত। সাওর গুহায় সাপের দংশনে আহত আবু বকর (রা.)-এর ক্ষতস্থানে নবীজি তার লালা লাগালে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
নারী চিকিৎসকদের উদ্দেশে ফয়েজী বলেন, “রাসূল (সা.) যুদ্ধক্ষেত্রে তার স্ত্রীদের নার্স ও চিকিৎসকের দায়িত্বে রাখতেন। তোমরাও চিকিৎসা পেশাকে ইবাদতের মতো গ্রহণ করো।” তিনি বলেন, “যুদ্ধক্ষেত্রে একজন ডাক্তার আহত সৈনিককে সুস্থ করে তুললে, সে নিজেও একেকজন অগ্রসেনানী হয়ে ওঠে।”
মায়েদের উদ্দেশে তিনি আহ্বান জানান, তারা যেন এমন সন্তান গড়ে তোলেন যারা ওমর, আবু বকর ও ওসমানের মতো বীরত্ব দেখাতে পারে। নবীজির ফুফু সুফিয়া (রা.)-এর উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “তিনি তাঁর ছোট সন্তান জুবায়েরকে কঠিন অনুশীলনে রাখতেন, যেন সে ‘নলির পুতুলের মতো’ বেড়ে না উঠে—বরং খাঁটি সোনা হয়ে উঠুক।”
চরিত্রের সংশোধন ও আত্মশুদ্ধির আহ্বান জানিয়ে ফয়েজী বলেন, “আজ যদি রাসূল (সা.) আমাদের মধ্যে থাকতেন, তিনি হয়তো বলতেন—অকারণে মোবাইল বন্ধ করে দাও, নিজের ভেতরটা ঠিক করো।”
তার মতে, সমাজের সবচেয়ে বড় সংকট বাহ্যিক নয়, চারিত্রিক। “আমাদের সুরত আর সিরতের মধ্যে যোজন যোজন ফারাক,” বলেন তিনি। “মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে হলে পশুপ্রবৃত্তি দমন করতেই হবে।”
ফিলিস্তিনের চলমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ভৌগোলিকভাবে সাহায্য না পারলেও, অন্তত আওয়াজ তোলা তো পারি।” তিনি আরও যোগ করেন, “বাংলাদেশের জমিন থেকে তোলা প্রতিটি চিৎকার হারিয়ে যায় না—ইথারে ভেসে গিয়ে তা জালিম শাসকের হৃদয়ে কম্পন ধরিয়ে দেয়।”
নবী করিম (সা.)-এর নেতৃত্বের মূল নীতি ছিল—‘রুহামাউ বাইনাহুম আস্বিদাউ আলাল কুফফার’—মুমিনদের প্রতি কোমল, আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর। তিনি বলেন, “আল্লাহ তাওবা সূরায় ঘোষণা করেছেন—তার পথে যারা জান-মাল বিলিয়ে দেয়, জান্নাত তাদের প্রাপ্য।”
নারীদের ভূমিকায় ফয়েজী বিশেষভাবে উল্লেখ করেন হযরত আয়েশা (রা.)-এর কথা। তিনি বলেন, “মাত্র ৯ বছরের সংসার জীবনে আয়েশা (রা.) ২১০টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। নবীজি তাকে আদর করে বলতেন ‘হুমায়রা’। এমনকি তিনি উপমা দিতেন—‘তরকারিতে যেমন লবণ দরকার, ইসলামে আয়েশা তার চেয়েও বেশি দরকারি।’
অনুষ্ঠানের শেষে দোয়া মাহফিলে বক্তারা রাসূল (সা.)-এর জীবনাদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজে ন্যায়, করুণা ও মানবিকতার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানান।