দিল্লির গাড়ি বিস্ফোরণ কি আত্মঘাতী হামলা ছিল?

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির ঐতিহাসিক লাল কেল্লার কাছে বিধ্বংসী গাড়ি বিস্ফোরণের ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। দেশটির তদন্তকারী সংস্থাগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে এটিকে এখনো সন্ত্রাসবাদী হামলা বলে ঘোষণা না করলেও ঘটনাপ্রবাহের যে বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে এবং এর সূত্র ধরে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা সে দিকেই দিকনির্দেশ করছে।
যদি এটি শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদী হামলা হিসেবেই চিহ্নিত হয়, তাহলে তা হবে ২০০৭ সালের পর ভারত শাসিত জম্মু ও কাশ্মির কিংবা পাঠানকোটের মতো সংলগ্ন এলাকার বাইরে বাকি দেশে প্রথম এই ধরনের হামলা। ২০০৭ সালে পুনের জার্মান বেকারিতে সর্বশেষ এরকম বড় মাপের সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছিল।
দিল্লিতে এই বিস্ফোরণের পেছনে কারা ছিল, কী কারণে বিস্ফোরণ ঘটল; তা জানতে প্রশাসন ও তদন্তকারী সংস্থাগুলো কোনো সম্ভাবনাই নাকচ করছে না বলে জানিয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে ওই বিস্ফোরণে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। তদন্তকারী কর্মকর্তারা কেউ কেউ আভাস দিয়েছেন, এটি একটি ‘ফিদায়িন’ ধাঁচের আত্মঘাতী হামলাও হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ঘটনার মূল সন্দেহভাজন হিসেবে উঠে এসেছে জম্মু ও কাশ্মিরের পুলওয়ামার একজন চিকিৎসক ড. উমর মোহাম্মদের নাম, যিনি লাল কেল্লার কাছে ওই বিস্ফোরক বোঝাই গাড়িটি তখন চালাচ্ছিলেন।
ঘটনাস্থলেই আটজন নিহত এবং আহত হয়েছেন ২৪ জনেরও বেশি। বিস্ফোরণের পরপরই ঘটনাস্থলে পৌঁছান দিল্লি পুলিশ, ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডের (এনএসজি) কর্মকর্তারা। প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে ১২ জনে পৌঁছেছে।
বিস্ফোরণের তীব্রতায় বেশ কয়েকটি গাড়ির অংশ ১০০ মিটারের বেশি দূরেও ছিটকে পড়ে। কয়েকজন পথচারী কিংবা অটোরিকশার যাত্রী রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। লাল কেল্লার নিকটবর্তী মেট্রো স্টেশনের কাছে ধ্বংসস্তূপ ঘেঁটে এখনো ‘‘ক্লু’’ কিংবা সূত্র খোঁজার কাজ চলছে।
দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য সব সম্ভাবনাই খোলা রাখা হয়েছে। বিস্ফোরণের তদন্ত নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণে মঙ্গলবার সকালে তিনি উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে সভাপতিত্বও করেন।
দেশটির এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এখনই নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়, বিস্ফোরণের কারণ কী। ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত নমুনা ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি (এফএসএল) এবং এনএসজি বিশ্লেষণ না করা পর্যন্ত আমরা কোনো সম্ভাবনাই উড়িয়ে দিচ্ছি না।
• বিস্ফোরণের শব্দ তিন-চার মাইল দূরেও
ভারতের ব্যস্ত রাজধানী দিল্লি শহর সোমবার সন্ধ্যায় স্তব্ধ হয়ে যায় বিস্ফোরণের শব্দে। অফিস ফেরত জনতার ভিড়ে ভরা পুরোনো দিল্লির মেট্রো স্টেশনের কাছে ওই গাড়িটি বিস্ফোরিত হয়েছিল। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, আগুন ছড়িয়ে পড়ে অন্তত ছয়টি গাড়ি ও বেশ কয়েকটি অটোরিকশায়।
লাল কেল্লা থেকে তিন-চার মাইল দূরে পূর্ব দিল্লির গীতা কলোনি থেকেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে বলে অনেকেই জানিয়েছেন। গ্রেটার নয়ডার বাসিন্দা ধর্মেন্দ্র নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, আমি রাস্তার ওপার থেকে হঠাৎ ভয়ানক একটা শব্দ শুনি। দেখি গাড়িতে আগুন ধরে গেছে।
‘‘তখন মারাত্মক ট্রাফিক ছিল, আর যে গাড়িতে বিস্ফোরণ হয় সেটি খুব ধীরে ধীরে চলছিল। ওখান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের ট্যাক্সিগুলোতেও।’’
বিস্ফোরণের পর দ্রুত আশপাশের হাসপাতালগুলোতে আহতদের ভর্তি করা হয়। সবচেয়ে বেশি আহত ভর্তি ছিলেন কাছেই লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ (এলএনজিপি) হাসপাতালে, সেখানে মঙ্গলবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও দু’জন প্রাণ হারিয়েছেন।
বিস্ফোরণে আহত আরও কয়েকজন এখনো হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। দিল্লি পুলিশের কমিশনার সতীশ গোলচা সোমবারই রাত ৯টার দিকে বলেন, সন্ধ্যা ৬টা ৫২ মিনিটের দিকে একটি ধীর গতিতে চলা গাড়ি লালকেল্লার বাইরের রেড সিগন্যালে থামে। ঠিক তখনই বিস্ফোরণ ঘটে। আশপাশের গাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এনআইএ, এফএসএল; সব সংস্থাই এই ঘটনার তদন্তে নেমেছে।
ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক টুইটে শোক প্রকাশ করে বলেন, দিল্লির বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছেন যারা, তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শোক জানাই। আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে রয়েছে।
• বিস্ফোরণে ব্যবহৃত হতে পারে আইইডি
প্রাথমিক তদন্তে অনুমান করা হচ্ছে, একটি ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) ওই গাড়ির ভেতরেই পুঁতে রাখা হয়েছিল। তদন্তকারী কর্মকর্তারা সে রকমই আভাস দিয়েছেন। তবে এটি সন্ত্রাসবাদী হামলা ছিল কি না, এখনো তা নিশ্চিতভাবে বলা হয়নি।
দিল্লি পুলিশের সূত্র বলেছে, বিস্ফোরণের সময় গাড়িটি থেমে ছিল বা খুব ধীরে চলছিল। কারণ জায়গাটিতে কোনো গর্ত বা চ্যাপ্টা অংশ পাওয়া যায়নি। আহতদের শরীরে পেলেটের চিহ্ন না থাকলেও দগ্ধ হওয়ার নিদর্শন মিলেছে।
মঙ্গলবার সকালে তদন্তকারীরা বলেছেন, ঘটনাস্থলে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থাকার আলামত পাওয়া গেছে; যে রাসায়নিক সোমবারই ফরিদাবাদে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। দিল্লির উপকণ্ঠে হরিয়ানার ফরিদাবাদ থেকে সোমবার সকালেই দু’জন চিকিৎসককে জেরা করে প্রায় ২ হাজার ৯০০ কেজি অ্যামেনিয়াম নাইট্রেট উদ্ধার করা হয়।
ফলে এই দুটি ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
• পুলওয়ামা কানেকশন?
বিস্ফোরিত গাড়িটি ছিল একটি সাদা রঙের হুন্দাই আই২০, যার নম্বর এইচআর ২৬সিই৭৬৭৪। গাড়িটি সোমবার বিকেল ৩টা ১৯ মিনিটে লাল কেল্লার কাছে একটি পার্কিং লটে ঢোকে এবং ৬টা ৩০ মিনিট নাগাদ বেরিয়ে আসে। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটে তীব্র বিস্ফোরণ।
তদন্তে জানা গেছে, ওই গাড়িটি কয়েকদিন আগেই পুলওয়ামার বাসিন্দা ড. উমর মোহাম্মদের নামে কেনা হয়েছিল। এর আগে, গাড়িটি একাধিক মালিকের হাতে হাতবদল হয়, কিন্তু সেই বদলগুলো মোটর ভেহিকেল বিভাগে নিয়মমাফিক নথিভুক্ত করা হয়নি।
তদন্তকারী সংস্থাগুলোর সূত্র বলেছে, ড. উমর মোহাম্মদ ছিলেন একটি সন্ত্রাসবাদী চক্রের সদস্য, যাদের দু’জন সদস্যকে সোমবারই দিল্লির কাছে ফরিদাবাদে গ্রেপ্তার এবং সেখান থেকে ২ হাজার ৯০০ কেজি বিস্ফোরক উদ্ধার হয়।
তদন্তকারীদের ধারণা, সহযোগীদের গ্রেপ্তারের খবর পাওয়ার পর উমর মোহাম্মদ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং আত্মঘাতী হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। বিস্ফোরণের সময় গাড়িটিতে সম্ভবত তিনি একাই ছিলেন।
• দেশজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার
দিল্লিতে বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল মানুষের শরীরের ছিন্ন ভিন্ন অংশ। এরপর গোটা দেশজুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করা হয়েছে। হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মুম্বাই, পুনে ও জম্মুতে উচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
দেশের বিমানবন্দরগুলোতেও বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা নজরদারি। বোম্ব স্কোয়াড ও স্নিফার কুকুর মোতায়েন করা হয়েছে বিভিন্ন বিমানবন্দরে। যাত্রীদের বাড়তি ও নিরাপত্তা তল্লাশির কারণে ফ্লাইট বিলম্বিত হতে পারে বলেও সতর্ক করেছে বিমান সংস্থাগুলো।
আকাশা এয়ার যাত্রীদের অনুরোধ করেছে, নিরাপত্তাজনিত অতিরিক্ত সময় বিবেচনায় রেখে উড়ান ছাড়ার অন্তত তিন ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে পৌঁছাতে। বাড়তি নিরাপত্তা কড়াকড়ির কারণে সারা দেশেই বিমানযাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। বিবিসি বাংলা।













