বছরের পর বছর বিচারের অপেক্ষা, রংপুর আদালতে ২৪ হাজার মামলার জট

রংপুরে বছরের পর বছর ধরে বিচারের আশায় আদালতের বারান্দায় ঘুরেও মিলছে না মামলাজট থেকে মুক্তি। বরং বিচারক স্বল্পতা, জনবল সংকট ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতায় বিচারিক কার্যক্রমে বাড়ছে দীর্ঘসূত্রতা। এতে ভয়াবহ মামলাজটের ফাঁদে পড়ে দুর্ভোগে জীবন কাটছে বিচারপ্রার্থীদের। কেউ কেউ সহায় সম্বল বিক্রি করে মাসের পর ধরে আদালতে আসছেন। তবুও পাচ্ছেন না কাঙ্ক্ষিত ন্যায় বিচার।
চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে এখানকার বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে ২৪ হাজারের বেশি মামলা। বিচারক স্বল্পতা, জনবল সংকট ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে এ জট।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে নতুন বিচারক নিয়োগ, জনবল বৃদ্ধি, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনসহ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। অন্যথায় ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে থাকবে সাধারণ মানুষ, প্রশ্নবিদ্ধ হবে বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতা।
রংপুর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সূত্রে জানা যায়, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের আওতাধীন আমলি আদালত ও বিচার আদালতে মাদক মামলা, নারী ও শিশু মামলা, এনআই অ্যাক্ট মামলা, যৌতুক নিরোধ মামলা, শ্রম মামলা, মোটরযান মামলা, সড়ক পরিবহন মামলা, ফৌজদারি বিধি মামলা, দ্রুত বিচার মামলাসহ বিভিন্ন মামলার বিচারকার্য চলমান রয়েছে।
এর মধ্যে ২০২৪ সালে আমলি আদালত ও বিচার আদালতে মোট মামলা ছিল ৫২ হাজার ২৫টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১১ হাজার ৯৯২টি, অন্য আদালতে বদলি হয়েছে ১৬ হাজার ৩৪১টি, বিচারাধীন রয়েছে ২৩ হাজার ৬৯২টি, পাঁচ বছরেরও অধিক সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে ৭৮৯টি এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলা স্থগিত রয়েছে দুটি।
এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত আমলি আদালত ও বিচার আদালতে মোট মামলা রয়েছে ৩০ হাজার ৯০৪টি। তিন মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে ২ হাজার ৮০৫টি, অন্য আদালতে বদলি হয়েছে ৪ হাজার ১৭৫টি, বিচারাধীন ২৩ হাজার ৯৪৩টি, পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারাধীন ৯০২টি এবং ৪টি মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে।
চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বারান্দায় কথা হয় এক নারীর সঙ্গে। তিনি নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ২৪ বছর থেকে এই কোর্টে আসি আর যাই। আজ হবে না কাল হবে নয়তো পরশু হবে। কখনো লম্বা লম্বা তারিখ দেয়। এভাবে বছরের পর বছর শুধু হয়রানির শিকার হচ্ছি। কোর্টের দরজায় আসতেছি আর যাচ্ছি কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। রায় হবে হবে করেও হয় না। কোনো সুফল পাচ্ছি না।
অপরদিকে রংপুর জেলা পুলিশের কোর্ট পরিদর্শকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে রংপুরের আট উপজেলার ৮টি থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে ৬৮৬টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ১৮১ জনকে। ২০২৪ সালে জেলা পুলিশের ৫৩৯টি মামলা করেছে পুলিশ। এতে আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ১৩৬ জনকে।
জেলা পুলিশের কোর্ট পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম বলেন, জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে বাদী হয়ে থানা পুলিশ যেসব মামলা করেছে, সেগুলো বিচারাধীন। পুলিশ আন্তরিকতার সঙ্গে মামলার তদন্ত, আসামি গ্রেপ্তার, চার্জশিট প্রদানসহ আইনি কার্যাবলি বাস্তবায়ন করছে।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা মনে করছেন, মামলা বিলম্বিত হলে সুযোগ পায় আসামিরা। এ কারণে এমন মামলা গুরুত্ব দিয়ে নিষ্পত্তি করা উচিত। বিচার বিলম্বিত হওয়ায় রাষ্ট্রের আইনি ব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা চলে আসে। একারণে নতুন আইনে এসব মামলা নিষ্পত্তি হলে ভালো হতো।
সরকারি কৌঁসুলি আফতাব হোসেন বলেন, রাষ্ট্র বাদী এমন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে মামলার সমন জারি, চার্জশিট দেওয়া, সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতে উপস্থাপনসহ কিছু কিছু মামলার রায় পর্যায়ে যেতে তিন-চার বছর সময় লেগে যায়।
মানবাধিকার কর্মী ও রংপুর মহানগর নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট পলাশ কান্তি নাগ বলেন, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আদালতে ঘুরে ঘুরে বিচারপ্রার্থীদের অনেকেই নিঃস্ব হয়েছেন। সেই মানুষগুলোর কথা ভাবতে হবে। আদালতে প্রতিমাসে বিচারপ্রার্থীরা আসেন, হাজিরা দেন আর বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। অভিযোগ করে কবে তারা ন্যায়বিচার পাবে- এর জবাব তো আমরা দিতে পারি না।
সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট জোবাইদুল ইসলাম বুলেট বলেন, রংপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারপ্রার্থীরা আদালতপাড়ায় বছরের পর বছর ঘুরে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণে বিচারকের স্বল্পতা দূর করতে হবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আদালত নির্দেশিত সময়ের মধ্যে মামলার সব আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলে মামলার সংখ্যাও কমে যাবে বিচারপ্রার্থীদেরও হয়রানি হতে হবে না।
এনআই













