প্রায় দেড়শ কোটি মানুষের দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রবণতা কম নয়। দিল্লি থেকে শুরু করে শত শত মাইল দূরে প্রান্তিক পর্যায়ের কোটি কোটি বাসিন্দার কাছেও রয়েছে ইন্টারনেট সুবিধা। চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালে গুগলে কোন বিষয়ে বেশি জানতে চেয়েছে জনসংখ্যায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশটির বাসিন্দারা?
২০২৫ সালের সার্চ-প্রবণতার বিশদ চিত্র তুলে ধরে গুগল প্রকাশ করেছে ইন্ডিয়াস ইয়ার ইন সার্চ ২০২৫: দ্য এ টু জেড অব ট্রেন্ডিং সার্চেস। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছর ভারতীয়দের অনলাইন অনুসন্ধানে বিনোদন, ক্রীড়া, প্রযুক্তি, জাতীয় ঘটনা ও দৈনন্দিন জরুরি তথ্যই ছিল আগ্রহের কেন্দ্রে।
• কোন বিষয়ে আগ্রহ
বিনোদন বিভাগে সবার উপরে ছিলেন ‘সাইয়ারা’ ছবির অনীত পাড্ডা ও আহান পান্ডে। চলতি বছরের সবচেয়ে বেশি ট্রেন্ডিং সিনেমা ছিল এটি। সিনেমাটির টাইটেল সং সবচেয়ে বেশি সার্চ করা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, আঞ্চলিক চলচ্চিত্রও এ বছর সার্চ তালিকায় বড় জায়গা দখল করেছে। হিন্দি সিনেমার সঙ্গে ‘কানতারা: এ লিজেন্ড চ্যাপ্টার ১’, ‘কুলি’, ‘মার্কোর’ মতো দক্ষিণ ভারতীয় ছবিগুলোও ট্রেন্ডিং তালিকায় উঠে এসেছে।
প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয় জানতেও ভারতীয়দের মধ্যে অনেক আগ্রহ দেখা গিয়েছে। গুগলের কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা প্ল্যাটফর্ম জেমিনি সামগ্রিক সার্চ-এর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, আইপিএলের পরেই। এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) টুল ব্যবহারের আগ্রহ বাড়ায় ডিপসিক, পারপ্লেক্সিটি, চ্যাটজিপিটি, গুগল এআই স্টুডিও এবং ফ্লো—এসব সম্পর্কেও ব্যাপক খোঁজখবর নিয়েছেন নেটিজেনরা।
ক্রীড়া বিভাগে বরাবরের মতোই এগিয়ে ছিল ক্রিকেট। ২০২৫ সালের আইপিএল নিয়ে সার্বিকভাবে সবচেয়ে বেশি সার্চ করা হয়েছে। নারীদের ক্রিকেটেও ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা গিয়েছে। বিশ্বকাপ জয়ের পরে জেমিমা রদ্রিগেজ নারী ব্যক্তিত্বের তালিকার শীর্ষে উঠে এসেছেন।
জাতীয় ঘটনা সার্চ প্রবণতায় প্রভাব ফেলেছে বছর জুড়ে। বর্ষীয়ান অভিনেতা ধর্মেন্দ্রর মৃত্যুর পর তার সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধান উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। পাশাপাশি মহা কুম্ভ মেলা নিয়েও আগ্রহ ছিল। এই মেলায় পৌঁছনোর যাত্রাপথ, আয়োজন ও ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্য জানতে বড় সংখ্যক সার্চ হয়েছে।
গুগল সার্চের ক্ষেত্রে বহু মানুষ ‘নিয়ার মি’ (আমার কাছে) ব্যবহার করে তথ্য খুঁজে নেন। সিনেমা হল, ওষুধের দোকান থেকে হাসপাতাল, অনেক কিছুরই খোঁজ করা হয়।
তবে ২০২৫ সালে অন্য একটি বিষয় সবচেয়ে বেশি খোঁজা হয়েছে ‘নিয়ার মি’ বিকল্প ব্যবহার করে। ‘আর্থকোয়েক নিয়ার মি’ ছিল বছরের সর্বাধিক অনুসন্ধান করা ‘নিয়ার মি’ প্রশ্ন। পাশাপাশি বাতাসের মান সংক্রান্ত সার্চও ছিল শীর্ষে।
লাবুবু খেলনা নিয়ে বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে এই বছরের শেষ ভাগে। ‘#৬৭ মি ‘ সামাজিক মাধ্যমে আলোড়ন তোলায় তা নিয়েও সার্চ বেড়েছে।
ভারতীয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা গুগলে রান্নার রেসিপি খুঁজেছেন। ঠেকুয়া ও উকড়িচে মোদকের মতো ঐতিহ্যবাহী রেসিপির পাশাপাশি ইয়র্কশায়ার পুডিংয়ের মতো বিদেশি খাবারও এ বছরের সার্চ তালিকায় স্থান পেয়েছে। উৎসব, ভ্রমণ ও আচার–অনুষ্ঠানকে ঘিরে নানা বিষয়ও সার্চের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।
স্কুইড গেম এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক শো, জনপ্রিয় সিরিজগুলোর পাশাপাশি সুনীতা উইলিয়ামসকে নিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ সার্চ করেছেন। ক্রিকেটার বৈভব সূর্যবংশীকে নিয়ে আগ্রহ দেখা গেছে।
• গুগল সার্চ বিশ্লেষণে মানসিকতার প্রকাশ
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘সাম্প্রতিক গুগল সার্চের প্রবণতা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, সাধারণ ভারতবাসীর আগ্রহ কোন দিকে। যে তিনটি বিষয় সবচেয়ে বেশি অনুসন্ধান করা হয়েছে, তা কেবল রাজনৈতিক ঘটনা নয়, বরং জনগণের মানসিকতারই প্রতিফলন।’’
তার মতে, ভারতে সিজফায়ার শব্দটি বহু বছর ধরে প্রচলিত, বিশেষত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। তবে ইদানিং এই শব্দের বহুল অনুসন্ধান প্রমাণ করে যে, মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। এই আগ্রহ কেবল ‘সিজফায়ার’ কী বা কারা, কেন ব্যবহার করে, তা জানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি মানুষের গভীর শান্তিপ্রীতির ইঙ্গিত দেয়।’’
সম্প্রতি ভারতে ওয়াকফ নিয়ে ফের আলোচনা তুঙ্গে উঠেছে। তারই সঙ্গে বেড়েছে সার্চের সংখ্যা।
রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তীর মতে, ‘‘ওয়াকফ বিল নিয়ে মানুষের আগ্রহের কারণ সুদূরপ্রসারী। ওয়াকফ সম্পত্তি হলো মুসলিমদের ধর্মীয় ও জনহিতকর কাজে ব্যবহৃত সম্পত্তি। দুঃখের বিষয় হলো, এত বিপুল পরিমাণ ওয়াকফ সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও মুসলমানদের একটি বড় অংশের মধ্যে দারিদ্র বেশি। মানুষ এখন জানতে চাইছে, এই আইন কি মুসলমান বিরোধী, নাকি এটি সত্যিই তাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য। মানুষের এই অনুসন্ধান প্রবণতা প্রমাণ করে যে, তারা সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও সমাজ সংস্কারের বিষয়ে গভীরভাবে আগ্রহী।’’
• এআই ব্যবহারের ভালো মন্দো, বিশ্লেষকেরা যা বলছেন
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপিকা মুনমুন ভট্টাচার্য বলেন, এআই ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ ভুল পথে চালিত হবে কি না বা যাচাই না করার প্রবণতা কতটা তৈরি হবে, সেটা দেখতে হবে। মানুষ কীভাবে এআইকে ব্যবহার করবে, তার উপরে এটা নির্ভর করছে। ভবিষ্যতে বিষয়টা বোঝা যাবে
এই অধ্যাপক আরো বলেন, সাধারণভাবে পড়ুয়ারা এখন নিজেরা লেখা ছেড়ে দিয়েছে। তারা চ্যাট জিপিটি, জেমিনিতে সার্চ করেই লিখে দিচ্ছে। লেখাটা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। আগে অন্তত পিডিএফ পড়ে কিছু বুঝত। কিন্তু এখন চ্যাট জিপিটি থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করে। তারা অনুসন্ধান করেও না যে, তা সঠিক তথ্য না ভুল তথ্য।
তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘চ্যাটজিপিটিতে যখন আমরা একটা বিষয় দিচ্ছি, ও কিন্তু ঠিকও দেয়, ভুলও দেয়। সেটা নির্ভর করে যে, ও সার্চ করে কী পেয়েছে। মানুষ কিন্তু শর্টকাটের জন্য এটাকে বড্ড বেশি ব্যবহার করছে। মানে সাহায্যের জন্য কম, বরং খাটনি থেকে বাঁচার জন্য। ফলে নলেজ গ্যাপ অর্থাৎ জ্ঞানের ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে।
মুনমুন এআইয়ের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বলেন, ‘‘জটিল সমস্যা সমাধানে এআই এখনও মানুষের গভীর বিচার-বিবেচনার বিকল্প হতে পারে না। কতটা আমি পড়ব আর কতটা চ্যাট জিপিটি থেকে নেব, এইটা শিখলে তবে কিন্তু এআই সঠিকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।''
সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ সন্দীপ সেনগুপ্ত এআই-এর ভবিষ্যৎ প্রভাব এবং এর নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, আগামী দিনে সমস্ত কাজই এআই দিয়ে হবে এবং এর ফলে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের চাকরি চলে যাবে। মানুষের জায়গায় সবকিছু রোবট দিয়ে হবে এবং যা কাজকর্ম হবে, সেই সমস্ত কাজগুলো কিন্তু এআই করে দেবে।
তিনি বলেন, ‘‘এআই নির্ভরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তা একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে। সুরক্ষার সমস্যা এখনও আছে, তখনও থাকবে। এআই নির্ভরতার ফলে যে প্রধান সমস্যাটি বাড়বে, তা হলো ডিপফেক।’’