প্রতিদিনের মৃত্যু, ক্ষুধা আর বেদনার মধ্যেও গাজার মানুষ আল্লাহর ওপর আস্থা হারায়নি। ফিলিস্তিনি দাঈ ও আলেম ড. জামীল মুতাওয়া সম্প্রতি আল-জাজিরা মুবাশেরের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘আয়্যামুল্লাহ’-এর এক পর্বে গাজার মানুষের দৃঢ় বিশ্বাসের কয়েকটি বাস্তব ঘটনা তুলে ধরেছেন—যেগুলো শোনার পর ঈমান, মানবিকতা ও হৃদয় কেঁপে ওঠে।
ড. মুতাওয়া বলেন, আমি ফজরের নামাজে এক মসজিদে প্রবেশ করলাম। দেখলাম এক ব্যক্তির তিনটি অঙ্গই কাটা, তবু তিনি চেয়ার টেনে নিয়ে ইমামের পেছনে প্রথম সারিতে বসে আছেন। চাইলে ঘরে বসেই নামাজ পড়তে পারতেন, কেউ দোষ দিত না। কিন্তু তিনি আমাদের আগেই পৌঁছে গেছেন আল্লাহর ঘরে। এটাই তো গাজা।
তিনি আরেকটি দৃশ্যের বর্ণনা দেন— ফজরের আজানের এক ঘণ্টা আগে থেকেই মসজিদে বসেছিল এক এতিম শিশু। মসজিদের লাইট অনেক উঁচুতে থাকায় ছোট হাত দিয়ে আলো জ্বালাতে পারছিল না। নামাজের প্রস্তুতির জন্য তার বিধবা মা তাকে আগেই মসজিদে পাঠিয়ে দিয়েছিল ।
ভাবুন, কেমন সেই মা, যে অন্ধকার ও বিপদের মধ্যেও সন্তানকে আল্লাহর কাছে মসজিদে পাঠিয়ে দেন ।
ইসরায়েলি বোমায় দুই পা হারিয়েছিল এক বালক। দীর্ঘ সময় অজ্ঞান থাকার পর যখন জ্ঞান ফিরে আসে, তার মুখের প্রথম কথা ছিল ‘আলহামদুলিল্লাহ’। ড. মুতাওয়া থেমে বলেন, এই একটি শব্দই বোঝায়, গাজার মানুষ আল্লাহর সঙ্গে কেমন সম্পর্ক রাখে।
একজন কোরআন শিক্ষক সম্পর্কে তিনি বলেন, তার মাথায় বড় একটি শেলবিদ্ধ ধাতব টুকরো আছে। ডাক্তাররা বলেছিলেন, মাথা বেশি নাড়াচড়া করলে মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু কিছুই হয়নি এমন ভাব ধরে মাথায় শেলবিদ্ধ ধাতব টুকরো নিয়ে তিনি মসজিদে যেতেন, নামাজ পড়তেন, শিক্ষার্থীদের কোরআন শেখাতেন। আজও সেই শেল তার মাথার ভেতরে রয়ে গেছে।
ড. মুতাওয়া বলেন, একটি বাড়ি বোমায় বিধ্বস্ত হয়। সবাই শহীদ হয়ে যায়। ৪৮ ঘণ্টা পর ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ছয় মাস বয়সী এক শিশুকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। সে এক হাত উঁচু করে তর্জনী তুলে রেখেছিল। তার আঙ্গুল যেন শাহাদাতের ইশারা করছিল।
ইসরায়েলি হামলায় স্বামী ও নয় সন্তানকে হারিয়েছিলেন আলা আন-নাজ্জার নামের এক চিকিৎসক । তবু হাসপাতালের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আহতদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তিনি সবসময় মুখে উচ্চারণ করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন... আল্লাহুম্মা আজিরনি ফি মুসিবাতি ওয়াখলুফলি খাইরান মিনহা। ড. মুতাওয়ার ভাষায়, তিনি সব হারিয়েছেন, কিন্তু ঈমান হারাননি।
এক বৃদ্ধ বাবার ৬ ছেলে একসঙ্গে শহীদ হয়েছেন। তিনি তাদের লাশ গ্রহণের সময় বলেছিলেন, হে আল্লাহ, আমি তোমার ফয়সালায় সন্তুষ্ট, তুমিও আমার ওপর সন্তুষ্ট হও। ড. মুতাওয়া বলেন, তার চোখে একফোঁটাও অশ্রু ছিল না, ছিল শুধু ঈমানের দীপ্তি।
ড. মুতাওয়া সাক্ষাৎকারের শেষে বলেন, আজ গাজায় যা দেখছি, তা সালফে সালেহিনদের (সৎ পূর্বপুরুষদের) ঈমানের বাস্তব রূপ। এই ঘটনাগুলো আজকের গাজার বাস্তবতা। কোনো বইয়ে লেখা গল্প নয়। গাজার মানুষ আজ যে ধৈর্য ও বিশ্বাসের দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে, ইতিহাস একদিন লিখবে ‘গাজা পৃথিবীর মানুষকে শিখিয়েছে ঈমানের অর্থ কী!
সূত্র : আল-জাজিরা মুবাশির